শূন্যে ভেসে আছে হেলিকপ্টার। তার পাখা ঘুরছে ডিগ ডিগ করে। ঝোলানো দড়ি বেয়ে একটি নির্দিষ্ট বাড়ির ছাদের উপরে চপার থেকে টুপ টুপ করে পড়ছেন সশস্ত্র কম্যান্ডোরা। ঠিক যেন আকাশ থেকে তারা খসছে একটার পর একটা। একটু পরেই তাঁরা মারণ হামলা চালাবেন ওই বাড়িতে ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিদের উপরে।
কলকাতা পুলিশের কম্যান্ডোরা এখনও পর্যন্ত ওই প্রশিক্ষণ হাতেকলমে পাননি। অথচ কলকাতা পুলিশের কম্যান্ডো বাহিনী তৈরি হয়েছে ১৯৯৬ সালে। কম্যান্ডোর সংখ্যা এখন ২০০। তবে এ বার সেই খামতি ঢাকার উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
আজ, সোমবার জঙ্গি হামলা মোকাবিলার মহড়া হিসেবে কলকাতা পুলিশের পাঁচ কম্যান্ডো শূন্যে ভাসমান হেলিকপ্টার থেকে ছাদে নামবেন। লালবাজার সূত্রে খবর, ব্যারাকপুর থেকে একটি হেলিকপ্টার কম্যান্ডোদের নিয়ে রওনা হবে। চপারটি তারাতলায় টাঁকশালের ছাদের উপর শূন্যে কিছুক্ষণের জন্য ভেসে থাকবে। হেলিকপ্টার থেকে ঝোলানো একটা মাত্র দড়ি বেয়ে টাঁকশালের ছাদে নামবেন কম্যান্ডোরা।
২৬/১১-এ হামলা চালানো জঙ্গিদের নিকেশ করে পণবন্দিদের উদ্ধার করতে দক্ষিণ মুম্বইয়ের ‘নরিম্যান হাউস’-এ এই ভাবেই নেমেছিলেন এনএসজি (ন্যাশনাল সিকিওরিটি গার্ড)-র কম্যান্ডোরা। আবার মার্কিন নৌবাহিনীর ‘সিল’ কম্যান্ডোরা পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের আস্তানায় নেমেছিলেন একই পদ্ধতিতে।
শূন্যে ভাসা হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে নামা এখন জঙ্গি হামলা মোকাবিলার প্রশিক্ষণে কম্যান্ডোদের কাছে জরুরি বলে গণ্য করা হয়। এনএসজি-র মতে, কোনও বাড়ি, বিশেষ করে বহুতল ভবন জঙ্গিদের কব্জায় থাকলে সেটি দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে এটাই কার্যকর পদ্ধতি। তাদের ব্যাখ্যা, ছাদে নেমে ঢুকলে উপর থেকে নীচে নামার সময়ে আক্রমণে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকা যায়।
কলকাতা পুলিশ এ দিন মহড়ার সুযোগ পাচ্ছে এনএসজি-র সৌজন্যে। একটি হেলিকপ্টার ভাড়া করে এনএসজি ওই মহড়া প্রথম বার দেবে কলকাতায়। কিছু দিন আগে লালবাজারকে এনএসজি জানায়, হেলিকপ্টার থেকে তারাতলায় টাঁকশালের ছাদে তাদের কম্যান্ডোরা নামবেন, কলকাতা পুলিশও চাইলে চার-পাঁচ জন কম্যান্ডোকে পাঠাতে পারে। সেই মতো পাঁচ কম্যান্ডোকে বেছে নিয়েছে লালবাজার। এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘হাতেকলমে এই প্রশিক্ষণ কম্যান্ডোদের জন্য খুব জরুরি ছিল। কিন্তু সেই সুযোগ আমরা আগে কখনও পাইনি। পরে সুযোগ এলে বাকি কম্যান্ডোদেরও পাঠানো হবে।’’
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, শহরে জঙ্গি হামলার মোকাবিলায় হেলিকপ্টার থেকে নামার প্রশিক্ষণ কম্যান্ডোদের থাকা জরুরি। বিশেষ করে, কলকাতায় যেখানে বহুতলের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে, ৪২তলা বাড়ি পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে।
হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে নামার সময়ে কলকাতা পুলিশের কমান্ডোরা প্রত্যেকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, বড় ও ছোট আগ্নেয়াস্ত্র, ব্যাগ, জলের বোতল, ছুরি সব মিলিয়ে ২১ কেজি ওজন বইবেন। লালবাজার সূত্রের খবর, মাটি থেকে ৫০ ফুট উঁচুতে থাকবে হেলিকপ্টারটি।
কলকাতা পুলিশের কম্যান্ডোরা মানেসরে এনএসজি-র সদর দফতরে সেনাবাহিনীর কাছে প্রশিক্ষণ নেন। তবে তাঁরা কখনও হেলিকপ্টার থেকে নামার প্রশিক্ষণ হাতেকলমে পাননি। হেস্টিংসে পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে দশতলা বাড়ি বা ১০০ ফুট উঁচু থেকে দড়ি বেয়ে নামার প্রশিক্ষণ নিয়মিত নেন কম্যান্ডোরা।
‘‘তবে এর সঙ্গে সত্যি সত্যি হেলিকপ্টার থেকে নামার তুলনা হয় না,’’ বলছেন লালবাজারের এক শীর্ষকর্তা। তাঁর ব্যাখ্যা, হেলিকপ্টার থেকে শূন্যে দড়ি বেয়ে নামার সময়ে বাতাসের ধাক্কা সামলাতে হয়, তা ছাড়া চপারের পাখার হাওয়ার ঝাপটাও সহ্য করতে হয়। তার উপরে কোমরের সঙ্গে ওই দড়ি আটকে রাখার ব্যাপারও নেই। তাই এ ক্ষেত্রে শারীরিক ক্ষমতা ও ভারসাম্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে হয় কম্যান্ডোদের।
কিন্তু বাস্তব অবস্থায় বহুতল দখল করে থাকা জঙ্গিরা হেলিকপ্টার থেকে কম্যান্ডোদের নামার সময়ে পাখি মারার মতো তাক করে এক-এক জনকে গুলি করে নামাতে পারে। এক কম্যান্ডো অফিসারের কথায়, ‘‘এ সব ক্ষেত্রে তাই আশপাশের উঁচু বাড়িতে স্লাইপার রাইফেল নিয়ে নিখুঁত নিশানাবাজদের রাখা হয়।’’
তবে সব ক্ষেত্রে এমনটা সম্ভব নয়। সেই জন্য প্রাক্তন এনএসজি কম্যান্ডো দীপাঞ্জন চক্রবর্তী বলছেন, প্রয়োজনে এক হাতে দড়ি বেয়ে নামতে নামতে অন্য হাতে গুলি চালাতে হতে পারে। সেই পরিস্থিতির কথা ভেবে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। দীপাঞ্জনবাবুর কথায়, ‘‘এক বার-দু’বার নয়, নিয়মিত এই তালিম নিতে হয়। এটা কিন্তু সার্কাস বা ট্র্যাপিজের খেলা নয়, জঙ্গি হামলার মোকাবিলা করার প্রশিক্ষণ।’’