প্রতীকী ছবি।
আকাশের দিকে চোখ তুললেও ফুটপাতটা যেন দেখতে পাই
সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন – ‘‘…সময়টা এক নয়-/ওর ওর তার/তোমার সময় দিয়ে তাই/বৃথা চেষ্টা আমাকে মাপবার’’। এক জনের কলকাতা দিয়ে আর এক জনের কলকাতাকেও মাপা কিংবা চাপা যায় না। সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বাড়িতে পুজোর ভোগ খেতে যেতাম কলেজের সহপাঠীর দৌলতে। খানাখন্দে ভরা রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময়ে মনে হত, কলকাতার আদি মালিকদের ধর্মতলায় প্রাসাদ নেই কেন? এখন ভাবি, প্রাসাদ যেখানেই হোক, সাধারণ মানুষের কী? এই দেশের লোক হলেও, সিন্ধিয়া-পটৌডিদের প্রাসাদে আমার প্রবেশাধিকার নেই, এই শহরের বাসিন্দা হলেও আলিপুরের কোনও বাংলোয় ঢুকে এক গ্লাস জল চাইতে পারি না। তাই বুঝতে পারি, অধিকাংশ মানুষের কাছেই দেশ মানে রাস্তা, পৃথিবী মানে রাস্তা, শহর মানেও তাই।
কলকাতার রাস্তা যে বিগত কয়েক বছরে বেশ ঝাঁ-চকচকে হয়েছে তা মানতেই হবে। তাতে পথচারী বা গাড়িচালকদের লাভ হয়েছে তা-ই শুধু নয়। ফুটপাতে বাস করেন এমন কিছু মানুষের মুখে শুনেছি যে এখন রাতে পিঠে খোঁচা কম লাগে, ঘুমটা শান্তির হয়। এ বার গতির মোহে রাতবিরেতে হুল্লোড় করতে বেরোনো অসংবৃত বাইক-আরোহীদের কেউ যেন এই মানুষগুলোর শান্তির ঘুমকে কালঘুমে বদলে দিতে না পারে, সেটা শহর যাঁরা চালান তাঁদের নিশ্চিত করতে হবে।
বিধানসভা ভোটে ডিউটি পড়েছিল। দক্ষিণ কলকাতার সরকারি হাসপাতালে করোনার প্রতিষেধক নিতে গিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম ভোলবদল দেখে। কুকুর-বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে না, আবর্জনা জমে নেই, একদম ঝকঝকে-তকতকে। সদ্যপ্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায় এক বার রসিকতা করে বলেছিলেন, কেওড়াতলা শ্মশান এত সুন্দর হয়ে গিয়েছে ওঁর আমলে যে জীবিত লোক গেলেও মরতে চাইবে। সে রকম সম্ভাবনা থাকলে শ্মশান একটু অপরিচ্ছন্নই থাকুক বরং, কিন্তু পরিচ্ছন্ন হাসপাতাল থেকে বেশি মানুষ সুস্থ হয়ে ফিরবেন অবশ্যই। এই ভাল লাগার গায়ে টোল পড়ল যখন এক বন্ধুর বাবাকে ভর্তি করাতে গিয়ে দেখলাম, টেবিলের তলার হাত, স্ট্রেচারের তলা দিয়েও বেরোচ্ছে।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কিংবা সিভিক পুলিশ ঘুষ চাইলে পরে কি তা অপরাধ নয়? দুর্নীতি কি কেবল বড় চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিরাই করেন?
উত্তর নিয়ে বিতর্ক হবে, সেই অবসরে একটা গল্প বলি। কলকাতার একটি ওয়ার্ডে এক জন সাইকেলে চাপা কাউন্সিলর ছিলেন পনেরো বছর। তাঁর জায়গায় যিনি এলেন, পাঁচ বছরের মধ্যেই দুটো বাড়ি আর তিনটি গাড়ি হাঁকানোর পরেও তিনি নির্বাচিত হলেন ফের। সাইকেল কেন হারল, এই প্রশ্নটা নিয়ে এলাকার সব চেয়ে বড় বস্তিতে গিয়ে দেখা গেল, চটের আড়াল দেওয়া কলঘরগুলোয় প্লাস্টিকের দরজা বসেছে। ‘‘আপনাদের বৌ-মেয়ে চট ঝোলানো বাথরুমে স্নান করেছে কখনও যে আমরা কোন কারণে, কী করেছি তা বুঝবেন?’’— প্রশ্ন নিয়ে যাওয়া এক জন মধ্যবিত্তকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন এক জন বস্তিবাসী।
এই গল্প হলেও সত্যি কেএকটা নয়। নয় বলেই, প্রোমোটারের থেকে স্কোয়ারফুট পিছু টাকা বুঝে নেওয়া যে লোকটার জন্য ফ্ল্যাটের মান কমে আর দাম বাড়ে, বস্তি জুড়ে গণবিবাহের আয়োজনও তাঁর উদ্যোগেই হয়তো হয়। বিপদে পড়লে যিনি সাহায্য করেন, সততার লেন্সে তাঁর বিচার অ্যাফোর্ড করতে পারেন ক’জন?
সৌন্দর্য ও সার্থকতার ভিতরকার দ্বন্দ্ব তাই অমীমাংসিতই থাকে। পুরসভার নতুন পঞ্চাশটা স্কুল হবে, না কি আলো আর শব্দের জৌলুসে মাতোয়ারা বিনোদনকেন্দ্র বা ভাসমান বাজার হবে, সেই সিদ্ধান্ত কারা নেবেন? করদাতারা না কি কর দেওয়ার জায়গায় যাঁরা নেই, তাঁরা?
দু’তরফের সিদ্ধান্ত দু’রকম হবেই তা নয়, মধ্যবর্তী বিন্দুতেও পৌঁছনো সম্ভব। যেমন, আমপানের পরে যে পাঁচ-সাত হাজার গাছ রাস্তায় পড়েছিল, তার কাঠ যদি রেললাইনের ধারে প্রায় আকাশের নীচে থাকা মানুষের বাড়ির ছাউনির কাজে ব্যবহৃত হত? গগনচুম্বী যে হাউজ়িং কমপ্লেক্সগুলো শহরের বিভিন্ন এলাকায় জন্ম নিয়েছে, তার অভ্যন্তরে যদি ভ্যানে করে আনাজ বেচা মানুষগুলোকে ঢুকতে দেওয়া হত, কর্পোরেটের থেকে আনাজ পর্যন্ত কেনার বাধ্যবাধকতা চুরমার করে?
ষোড়শ শতাব্দীর জ্যোতির্বিজ্ঞানী টিকো ব্রাহের বলা একটি শব্দযুগল চেক রাজধানী প্রাগ-এর বিশেষণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, ‘‘সাসপিসিয়েনডো ডেসপিসিও’’, অর্থাৎ, ‘‘উপরের দিকে তাকালে আমি নীচটা দেখতে পাই’’।
আগামীর কলকাতা সম্বন্ধেও এটা প্রযোজ্য হতে পারে না?