রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়েই নিজস্বী তোলায় ব্যস্ত যুগল। রবিবার রাতে, পার্ক স্ট্রিটে। নিজস্ব চিত্র
রাত একটায় মোমো-রেস্তোরাঁয় ঠাসাঠাসি ভি়ড়! সাহেবি রেস্তোরাঁর দরজা ঠেলে এক দল বেরোচ্ছে তো অন্য দল সেঁধিয়ে যাচ্ছে ভিতরে। ফুটপাথে সার দিয়ে বসে থাকা তরুণ-তরুণীর দল অনবরত ভেঁপু বাজিয়ে যাচ্ছে। গা়ড়ি আর ভিড় সামলাতে নাজেহাল হচ্ছেন পোড়খাওয়া পুলিশ অফিসারেরাও।
রবিবার রাতে পার্ক স্ট্রিটের এই ছবিটাই যেন শহরের শীতকালীন উৎসবের মুখ।
ছুটিবারের সকাল থেকেই পথে নেমেছিল আমজনতা। চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া ময়দান ঘুরে সন্ধ্যায় ভিড় উপচেছিল পার্ক স্ট্রিটে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতকাবার হলেও সেই ভি়ড়ের ছবিটা বদলায়নি। বরং রাত যত বেড়েছে, ততই বেড়েছে হুল্লোড়। সেই হুল্লোড়ে অবশ্য মিশেছিল বিশৃঙ্খলাও। তবে বড় ধরনের কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার কথা শোনা যায়নি। পুলিশ জানিয়েছে, নিরাপত্তার কথা ভেবে পার্ক স্ট্রিট-সহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। ছিল কড়া নজরদারিও। সোমবার লালবাজার জানিয়েছে, রবিবার রাতে বিশৃঙ্খলার জন্য মোট ৬৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালানোর জন্য পাকড়াও করা হয়েছে ২৮ জনকে।
রাত দশটা। পার্ক স্ট্রিটের সাবেকি পানশালা থেকে বেরিয়ে এল দলটি। তার পরেই হামলে পড়ল ফুটপাথে কিশোরীর সান্তাটুপির পসরার উপরে। লাল টুপি মাথায়, ভেঁপু মুখে মধ্য তিরিশের সেই দলটির হুল্লোড় দেখে পথচলতি অনেকেই হেসে কুটোপাটি। ঠিক উল্টোদিকেই তখন জড়ো হয়েছেন বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের এক দল ছাত্র। রাতভর হুল্লোড়ে বান্ধবীদের অপেক্ষায় ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটাও যেন ঘণ্টার সমান!
অ্যালেন পার্কের গেটে তালা পড়ে গিয়েছে অনেক ক্ষণ আগে। তবু রাত সাড়ে ১০টায় অ্যালেন পার্কের গেটে নিজস্বী তোলার হুজুগে অন্ত নেই। সদ্য প্রেমে পড়া কলেজপড়ুয়ারাই হোক কিংবা কিশোর ছেলের হাত ধরে বেড়াতে আসা দম্পতি— নিজস্বী-প্রেমীদের সামলাতে দম ফেলার ফুরসত ছিল না পুলিশের। কাছেই ওয়াকিটকি হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক মাঝবয়সী পুলিশ অফিসার। ভিড়ের এই চরিত্র দেখে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আগে ক্রিসমাস ইভে এমন ভিড় হত না। বছর বছর যেন পার্ক স্ট্রিট দর্শনের হুজুগ বা়ড়ছে।’’ পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ অফিসার অবশ্য টিপ্পনী জুড়লেন, ‘‘স্যার, গত বছর নোটবন্দির জন্য বোধ হয় ভি়ড়টা একটু কম ছিল।’’
পার্ক স্ট্রিট যখন রাতভর হুল্লো়ড়ে মাতার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তত ক্ষণে লম্বা লাইন পড়ে গিয়েছে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের সামনে। সেখানেই মধ্যরাতের প্রার্থনায় যোগ দিতে হাজির হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক দিকে ‘ভিআইপি’, অন্য দিকে ভিড়— দুইয়ে মিলে আটোসাঁটো নিরাপত্তায় তটস্থ উর্দিধারীরা। বেসামাল মনোভাব দেখলেই কড়া কথায় ধমকে দিচ্ছিলেন পুলিশকর্মীরা।
শহরের রেস্তোরাঁ পাড়া থেকে যাঁরা দূরে থাকতে চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই হাজির ট্যাংরার চিনে পাড়ার রেস্তোরাঁগুলিতে। রাত বাড়ার পরে অবশ্য সেই ভি়ড় ফিকে হয়েছে। রাত সাড়ে এগারোটায় অ্যালেন পার্কের সামনেই দেখা হল সোমশ্রী ও তাঁর হবু বরের সঙ্গে। সোমশ্রী বললেন, ‘‘পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁয় এ দিন ঠাঁই মেলা দুষ্কর। চিনেপাড়ায় অবশ্য ততটা হুজ্জুত পোহাতে হয়নি।’’
এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল। রাত বারোটা পেরোতেই উৎসবের মেজাজে লাগল বিশৃঙ্খলার আঁচ। বিড়লা তারামণ্ডলের পাশে আঁধারে এক মত্ত তরুণীকে নিয়ে বেসামাল হুল্লো়ড়ে মাতছিলেন কয়েক জন তরুণ। আচমকাই দু’জন পুলিশকর্মীকে এগিয়ে আসতে দেখেই সরে পড়লেন তাঁরা। পানশালা থেকে বেরোনো কেউ কেউ পথচলতি মহিলাদের উদ্দেশে অশ্লীল মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছে। ধর্মতলার মোড়ে মোটরবাইক থেকে অনবরত কটূক্তি শোনা গিয়েছে পথচলতি লোকজনের দিকে।
আমজনতার ভিড় অসভ্যতা না করলেও ট্র্যাফিক আইনের তোয়াক্কা করেনি। ভিড়ের কারণে পার্ক স্ট্রিটে এমনিতেই গাড়ির গতি ছিল ঢিমে। তার উপরে যখন-তখন ফুটপাথ থেকে টলোমলো পায়ে রাস্তায় চলে আসছিলেন অনেকে। বিপদ রুখতে গার্ডরেলের ফাঁকে যেটুকু ফাঁকা ছিল তা-ও এক সময় আটকে দেয় পুলিশ। অকারণে অনবরত রাস্তা পারাপার ঠেকাতে রাত বারোটার পর স্টিফেন কোর্টের দিক থেকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ঢোকার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ক’জন পুলিশকর্মী। তাঁদেরই এক জন বললেন, ‘‘এই রাস্তা না আটকালে এই ভিড় সামলানো দায় হত।’’ কিন্তু জোয়ারের মতো এসে প়ড়া ভিড়কে গার্ডরেলের বাধায় আর কতই বা আটকানো যায়। মাঝেমধ্যেই দল বেঁধে রাস্তায় নেমে পড়েছেন অনেকে। ব্যাঘাত ঘটেছে যান চলাচলে।
রাত একটার পরে শহরের অন্যান্য প্রান্ত ক্লান্ত হলেও পার্ক স্ট্রিটের মেজাজ ছিল অটুট। হুল্লোড়ে ক্লান্ত হয়ে ফুটপাথে সার দিয়ে বসে পড়েছিলেন অনেকে। কেউ কেউ আবার অধিক পানাহারে বন্ধ দোকানের সামনেই রাত কাটানোর সুযোগ খুঁজছিলেন। এমন সময়েই দেখা গেল হাজির এক দল পুলিশ। বাঁশি বাজিয়ে ধমকের সুরে এলাকা ফাঁকা করার নির্দেশ দিলেন তাঁরা। আমোদ ছেড়ে বাড়িমুখো হওয়ার অনেকেরই ইচ্ছে ছিল না তবুও উর্দির ধমক খেয়ে গুটিগুটি সরে প়়ড়লেন তাঁরা। রাত দু’টোর পরে পার্ক স্ট্রিটের ভিড় তত ক্ষণে অনেকটাই ফিকে। হুজুগে জনতাকে সামলে ক্লান্ত পুলিশকর্মীরাও ঘরমুখো হওয়ার অপেক্ষায়।
কান পাতলে তখনও শোনা যাচ্ছিল বড়দিনের ভেঁপু!