‘জল কই’, তপ্ত দিনে প্রশ্নে নাজেহাল শাসক-প্রার্থীরা

প্লাস্টিক ব্যাগ-ভর্তি স্যান্ডো গেঞ্জি! কিন্তু হুডখোলা জিপ গাড়িতে এত গেঞ্জি কেন? ভোট প্রচারে বেরিয়ে কি গেঞ্জি বিলি করছেন? প্রশ্নটা শুনেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একগাল হেসে বালিগঞ্জ কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী তথা মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘না-না। যা গরম, খুব ঘাম হচ্ছে। এক-দেড় ঘণ্টা অন্তর তাই স্যান্ডো গেঞ্জি চেঞ্জ করছি। না হলে ঠান্ডা-গরম লেগে যাবে তো!’’

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৬ ০১:২৭
Share:

তৃণমূল প্রার্থী মদন মিত্রের প্রচারে অভিনেতা আসরানি। সঙ্গে সৌগত রায়।

প্লাস্টিক ব্যাগ-ভর্তি স্যান্ডো গেঞ্জি!

Advertisement

কিন্তু হুডখোলা জিপ গাড়িতে এত গেঞ্জি কেন? ভোট প্রচারে বেরিয়ে কি গেঞ্জি বিলি করছেন?

প্রশ্নটা শুনেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একগাল হেসে বালিগঞ্জ কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী তথা মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘না-না। যা গরম, খুব ঘাম হচ্ছে। এক-দেড় ঘণ্টা অন্তর তাই স্যান্ডো গেঞ্জি চেঞ্জ করছি। না হলে ঠান্ডা-গরম লেগে যাবে তো!’’

Advertisement

শুধু প্রতিপক্ষকে কব্জা করতেই নয়। প্রখর তপনতাপের হাত থেকে এ ভাবেই নানা কৌশলে শরীর বাঁচিয়ে ভোট প্রচারের চতুর্থ রবিবারকে কাজে লাগালেন শাসক থেকে বিরোধী, সকল প্রার্থীই। ঘামের হাত থেকে বাঁচতে বালিগঞ্জের বর্ষীয়ান নেতা যেখানে ব্যাগভর্তি স্যান্ডো গেঞ্জি নিয়ে প্রচারে, সেখানে উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুরের তৃণমূল প্রার্থী তথা মন্ত্রী শশী পাঁজা প্রচারের ফাঁকেই কিনে নিয়েছেন সজনে ডাঁটা। চিকিৎসক প্রার্থীর কথায়, ‘‘গরমে ডাঁটার ঝোল খাওয়া খুব উপকারী।’’ কেউ কেউ আবার প্রচারে গিয়ে গলা ভেজাতে চেয়ে নিয়েছেন নুন-চিনি-লেবুর সরবত।

রবিবার দিনের শুরু থেকেই তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৪০ ছুঁই ছুঁই। তাই কালবিলম্ব না করেই সকাল সকাল এলাকায় ভোট প্রচারে বেরিয়ে পড়েছিলেন প্রার্থীরা। শশী পাঁজা যেমন সকাল ৭টাতেই ভোট চাইতে হাজির। এ দিক-ও দিক ঘুরে সকাল পৌনে ৯টা নাগাদ হাটখোলা বাজার। রাস্তার উপরে বসা সব্জিবিক্রেতাদের হাতে নববর্ষের শুভেচ্ছার পকেট ক্যালেন্ডার তুলে দিয়ে ভোট চাওয়ার ফাঁকেই কিনে ফেললেন সজনে ডাঁটা। কলকাতা তখন তাপপ্রবাহের জন্য তৈরি হচ্ছে।

বেলেঘাটার সিপিএম প্রার্থী রাজীব বিশ্বাস আবার তপ্ত দিনে চাউলপট্টিতে ঢুকেই এক বাড়ির সামনে হাঁক পাড়লেন, ‘দিদি এক গ্লাস জল দিন না! নুন-চিনির জল হলে ভাল।’ রাজীব অবশ্য প্রচারে বেশি জোর দিচ্ছিলেন যুব সমাজের উপরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তেলেভাজা শিল্পে ভর করে জীবনে উন্নতি করা যাবে না দাবি করে বোঝাচ্ছিলেন পথচলতি যুবকদের। সকালে বারোয়ারিতলার রাস্তায় কয়েক জন যুবকের সঙ্গে দেখা হতেই এক জনের হাত ধরে বললেন, ‘‘শোনো ভাই, তেলেভাজা শিল্প করে দোতলা বাড়ি বানানো যাবে না। এর জন্য চাই ঠিক কর্মসংস্থান।’’ দিদির হাতে জল পান তার ফাঁকেই।

রাজীবের প্রতিপক্ষ, বেলেঘাটার বিদায়ী বিধায়ক পরেশ পালের আবার একেবারে ঠান্ডা জল পছন্দ নয়। গরমে শরীর ঠিক রাখতে ঘন ঘন জলই খাচ্ছেন, তবে ঠান্ডা নয়। এ দিন প্রচারের শেষ লগ্নে চিংড়িঘাটায় স্থানীয় এক কলোনির মহিলাদের হাতে ‘বন্দি’ হতে হল পোড়খাওয়া পরেশবাবুকে। সকাল থেকে ৬টা ঢাক, নীল-সাদা বেলুনে সাজানো হুড খোলা গাড়িতে শোভাযাত্রা করে মেট্রোপলিটন, পূর্বায়ন ঘুরে ওই এলাকায় পৌঁছতেই সামনে এল পানীয় জলের সমস্যা। কৌশলে সেই ক্ষোভ সামাল দিয়ে পরেশবাবুর ঘোষণা, ‘‘ঠিক আছে, কাল থেকে জলের গাড়ি এলাকায় থাকবে। এখন এক গ্লাস জল দাও।’’

উত্তর কলকাতায় যখন পানীয় জলের সমস্যা নিয়ে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলছেন পরেশবাবু, দক্ষিণে তখন বন্দর এলাকার প্রার্থী তথা মন্ত্রী ববি হাকিমের কাছে চেতলা বাজার এলাকার কয়েক জন মহিলা দাবি তুলেছেন, আলাদা ভাবে জরুরি কথা বলবেন। পুরমন্ত্রী অবশ্য তাঁদের কথা শুনতে রাজি হননি। বরং তাঁর জবাব, ‘‘এখন কোনও কথা নয়। ভোট মিটুক, যা বলবেন সব করে দেব।’’ এক দিকে মাথার উপরে গনগনে রোদ, অন্য দিকে নারদের আঁচ। রবিবাসরীয় প্রচারে সব কিছু সামাল দিতে তাই ভোট প্রচারের শুরুতেই ‘বেড়াল মারার’ চেষ্টা করেছেন বন্দরে শাসক দলের এই প্রার্থী। বলেছেন, ‘‘যেহেতু নারদে আমার নাম জড়িয়েছে তাই বলছি, আমি সৎ। এই সব ভুল, মিথ্যা ছবি দেখানো হচ্ছে।’’ আর ফিরহাদের প্রতিপক্ষ জোটপ্রার্থী রাকেশ সিংহ সকাল থেকেই বন্দর এলাকার ৭৯ ও ৮০ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়ি-বাড়ি প্রচারের ফাঁকে বলেছেন, ‘‘সারদা থেকে নারদ— সব কিছুতেই ববি হাকিম পাণ্ডা। তাই এ বার আমাকে ভোট দিয়ে মানুষ তার জবাব দেবেন।’’

রাজ্যের অন্যতম মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম যখন একাংশের ‘বিতর্কিত’ কথা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন, পোড়খাওয়া সুব্রত মুখোপাধ্যায় তখন একের পর এক বহুতলে ঢুকে ভোটের আগাম আঁচ বোঝার চেষ্টা করেছেন। পণ্ডিতিয়া রোডের এক বহুতলে তাঁকেও শুনতে হয়েছে পানীয় জলের সমস্যা, রাস্তার উপরে বাজার বসা নিয়ে বিবিধ অভিযোগ। তবে প্রচার-সঙ্গী মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমারকে পাশে নিয়ে সব কিছুতেই ছক্কা হেঁকেছেন নারদ-কাণ্ডে জড়িয়ে পড়া সুব্রতবাবু।

মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের নিজের কেন্দ্র বেহালা (পূর্বে) প্রচার কার্যত শেষ। এ দিন সকালেই তাই পাথরপ্রতিমার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন তিনি। বিরোধীদের মতো গরমকেও তেমন আমল দিতে নারাজ ছিলেন টালিগঞ্জের তৃণমূল প্রার্থী তথা মন্ত্রী অরূপ বি‌শ্বাস। সকাল ৮টা থেকে দুপুর পৌনে ১টা পর্যন্ত প্রচারের মাঝে কিছুক্ষণের বিরতিতে দুধ-চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘‘ঠান্ডা-গরম, কোনও কিছুতেই আমার কষ্ট নেই। তবে গরমে টক ডাল আর আলুভাতে বেশি খাচ্ছি। সঙ্গে নিয়ম করে জল।’’

রবিবারের ভোট-ময়দানে ছক্কা হাঁকাতে পিছিয়ে ছিলেন না বিরোধীরাও। সকালে বোসপুকুর থেকে আনন্দপুর পর্যন্ত অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী, প্রদীপ ভট্টাচার্য, শ্যামল চক্রবর্তীকে নিয়ে রোড শো করেছেন জোটপ্রার্থী শতরূপ ঘোষ।

তবে প্রচারের ক্ষেত্রে পেশাদার অভিনেতা বিশেষ কোনও দলের কেউ নন। বলিউডের অভিনেতা আসরানি যেমন। শুক্রবার আসানসোল (উত্তর) কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রচারে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এ দিন পড়ন্ত বিকেলে দেখা গেল কামারহাটিতে, তৃণমূল প্রার্থী তথা জেলবন্দি মন্ত্রী মদন মিত্রের প্রচারে। ফিল্মি তারকাদের প্রচারে আনার নজির অবশ্য আগেও ছিল মদনের। এমনকী, নারদের ভিডিওতেও ২০১৪-র লোকসভা ভোটের প্রচারে বলিউডি তারকাদের আনার বিষয়ে ফোনে কথা বলতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এ দিন শাসক দলের প্রচারে সাংসদ সৌগত রায়, মদনের পরিবার, কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক, ছৌ নাচ, বাউল ও লাইভ গানের অনুষ্ঠান মিলিয়ে দেড় ঘণ্টার টানা প্রচারপর্বে ‘শোলে’ খ্যাত অভিনেতাকে দেখে এক সিপিএম নেতার সহাস্য মন্তব্য, ‘‘এ তো ‘অংরেজ জমানার জেলর’ এলেন জেলবন্দির প্রচারে!’’ দেড় ঘণ্টা পরে ঘামে জবজবে পোশাকে ‘জেলর’-এর অবশ্য তখন প্রায় ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা!

এ দিকে, শাসক দলের ‘দিদি’র এলাকা গোপালনগরে সকালেই বাড়ি বাড়ি প্রচার সেরেছেন প্রতিপক্ষ ‘বৌদি’। বিকেলে অবশ্য তিনি, ভবানীপুরের জোটপ্রার্থী দীপা দাশমুন্সি ভোট চাইতে যান খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের পাড়াতেও।

ভোট-বাজারে গরম বাড়ার ইঙ্গিত?

রবিবার ছবিগুলি তুলেছেন সজল চট্টোপাধ্যায়,
সুদীপ্ত ভৌমিক এবং শৌভিক দে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement