হেলমেট না-থাকলে পেট্রোল নয়— পথ নিরাপত্তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়া অবস্থান নিতেই এমন নিয়ম করেছে কলকাতা পুলিশ। কিন্তু গাড়ির ক্ষেত্রে সুরক্ষার প্রাথমিক শর্ত সামনের আসনে সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করতে কী করছে সরকার? সিটবেল্ট ঠিকমতো বাঁধা থাকলে অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় বড়সড় আঘাতও এড়িয়ে যাওয়া যায়। অথচ সাধারণ মানুষ, এমনকী ভিভিআইপি বা মন্ত্রী-সান্ত্রীরাও দিব্যি ঘুরে বেড়ান সিটবেল্ট ছাড়া।
ঠিক এই কারণেই অবশ্য তাঁরা সিটবেল্ট নিয়ে কড়াকড়িতে অপারগ বলে জানাচ্ছেন রাজ্য পুলিশের কর্তাদের একাংশ। এক কর্তার কথায়, ‘‘যেখানে মন্ত্রীই সিটবেল্ট বাঁধেন না, সেখানে কাকেই বা সিটবেল্ট বাঁধতে বলব!’’ রাজ্য জুড়ে ‘সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফ’-এর সরকারি প্রচার শুরুর পরে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হতে কার্যত বাধ্য হয়েই সিটবেল্ট নিয়ে কড়া হতে চলেছে কলকাতা পুলিশ। তবে তা অবশ্যই সাধারণ জনগণের জন্য, ভিআইপি-দের জন্য নয়।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০০৩-এর অক্টোবরে নয়াদিল্লি কেন্দ্রীয় মোটর ভেহিক্লস আইনে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। তাতে ২০০৪-এর অক্টোবর থেকে সব গাড়িতেই চালক ও তাঁর পাশের আসনে বসা যাত্রীর সিটবেল্ট লাগানো বাধ্যতামূলক করা হয়। গাড়ি সংস্থাগুলিকেও এই নির্দেশ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন তাই সব গাড়িতেই সিটবেল্ট আছে। কিন্তু তা ব্যবহারে চালক এবং যাত্রীর অনীহার কারণে তা বাস্তবায়ন হয়নি।
এক পরিবহণ কর্তার মতে, সিটবেল্ট পাশের লক-এ আটকে থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই বড়সড় দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। আচমকা গাড়ি ব্রেক কষার জেরে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লে ওই বেল্ট চালক ও যাত্রীকে পিছন থেকে টেনে ধরে। ফলে প্রাণহানি বা বড় আঘাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনা থাকে। এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, বাণিজ্যিক গাড়ি বা ট্যাক্সির ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ চালক বা যাত্রীই নিয়ম মানেন না। অনেক ট্যাক্সিতে সিটবেল্টের লক খারাপ থাকে। বছরে এক বার ফিটনেস শংসাপত্র নিতে আসার সময়ে কোনও রকমে তা মেরামত করে পাঠানো হয়। দু’দিনে আবার যে-কে-সেই। অনেক ক্ষেত্রে আবার পুলিশের চোখ এড়াতে
বুকের উপরে সিটবেল্ট ফেলে রেখে দেন চালক।
পরিস্থিতি এমনই যে, যাত্রী-সুরক্ষায় বিষয়টি নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণের কথা ভাবছেন পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত। তিনি বলেন, ‘‘মানুষের সচেতনতা এবং প্রশাসনের তৎপরতা না থাকলে কোনও আইনই প্রয়োগ করা যায় না। কলকাতা হাইকোর্টে ট্রাফিক সংক্রান্ত যে মামলা রয়েছে, তাতে সিটবেল্ট না পরার বিষয়টি যোগ করব।’’
সিটবেল্ট যে প্রয়োজন, তা মানছেন শাসক এবং বিরোধী— দু’পক্ষের ট্যাক্সি সংগঠনের নেতারাই। শাসক দলের ট্যাক্সিমালিক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সিমেন্স ইউনিয়নের নেতা শুভরূপ মিত্র বলেন, ‘‘মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ‘সেফ ড্রাইভ সেফ লাইফ’ প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে আমরা বাইকচালকদের হেলমেট বিতরণ করেছি। খুব শীঘ্রই ট্যাক্সির ক্ষেত্রেও সিটবেল্ট পরার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রচারের কথা ভেবেছি।’’
সিটু সমর্থিত ট্যাক্সি চালক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রমোদ ঝা বলেন, ‘‘অধিকাংশ ট্যাক্সিচালকই নিজেদের ভাল বোঝেন না। এ জন্য সরকার ও পুলিশকে আমরা আরও সক্রিয় হতে অনুরোধ করব। আমরা সচেতনতা প্রচার চালাই। ভবিষ্যতেও চালাব।’
কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের (ডিসি) ভি সলোমন নেসাকুমারও জানান, সিটবেল্ট না-বাঁধায় গত তিন মাসে কলকাতায় প্রায় ছ’হাজার গাড়িকে জরিমানা করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন, ভিআইপি-র ক্ষেত্রে কি আদৌ জরিমানা করা হয়? সদুত্তর মেলেনি।
লালবাজারের কর্তাদের দাবি, খুব শীঘ্রই হেলমেটের মতো সিটবেল্ট নিয়েও অভিযান শুরু হবে। সেখানে ভিআইপি-দেরও ছাড় দেওয়া হবে না। প্রকাশ্যে অবশ্য এমন বিতর্কিত মন্তব্য থেকে নিজেদের বিরত রাখছেন লালবাজারের কর্তারা। কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বিনীত গোয়েল বলেন, ‘‘এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হবে। সিটবেল্ট না-বাঁধা অবস্থায় ধরা পড়লে সব ক্ষেত্রেই চালকদের জরিমানা করা হয়। ভবিষ্যতেও করা হবে। কিন্তু আমরা বেশি জোর দিচ্ছি সিটবেল্ট বাঁধা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উপরে।’’
বিনীতবাবু যা-ই বলুন না কেন, ভিভিআইপি এবং ভিআইপি-দের গলায় সিটবেল্ট কে পরাবেন, তা নিয়ে ধন্দে তাবড় পুলিশকর্তারা।