তদন্ত: নিহত চঞ্চল মণ্ডলের বাড়িতে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা। সোমবার, নিউ টাউনে। ছবি: শৌভিক দে
জমি জরিপকারী হিসেবে সুখ্যাতি ছিল। বছর পাঁচেক আগে বাড়তি রোজগারের আশায় জমি কেনাবেচার ব্যবসা শুরু করেন চঞ্চল মণ্ডল (৪৬)। সেটাই কি কাল হল তাঁর? নিউ টাউনের পাথরঘাটায় রবিবার ভরসন্ধ্যায় বাড়ির ভিতরে ঢুকে চঞ্চলকে খুনের ঘটনায় আপাতত যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর পেতে জমিতেই নজর বিধাননগর কমিশনারেটের তদন্তকারীদের। সোমবার ডিসি (সদর) অমিত জাভালগি বলেন, ‘‘প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে, খুনের পিছনে ব্যবসায়িক শত্রুতা ছিল।’’
পরিবার সূত্রের খবর, উচ্চ মাধ্যমিকের পরে আমিনের কাজ শুরু করেন চ়ঞ্চল। নিহতের স্ত্রী দীপিকা মণ্ডল জানান, একটি বেসরকারি সংস্থায় এই মুহূর্তে ১৭টি প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন চঞ্চল। নিহতের ছেলে, স্নাতক স্তরের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অমিত বলেন, ‘‘জমি কেনাবেচার ব্যাপারে ওই সংস্থায় বাবাই ছিলেন শেষ কথা।’’ দীপিকা জানান, ১৭ হাজার ৮৭০ টাকার চাকরিতে সন্তুষ্ট ছিলেন না তাঁর স্বামী। বছর পাঁচেক আগে জমির দালালির ব্যবসায় চঞ্চলের হাতেখড়ি। দীপিকা বলেন, ‘‘ওই জমিটি ছিল কলকাতার এক ব্যবসায়ীর। সম্প্রতি আর একটি জমি নিয়ে কথাবার্তা চলছিল।’’ শ্বশুরের চিকিৎসায় চঞ্চল দেড় লক্ষ টাকা দেনা করেছিলেন বলেও জানান তাঁর স্ত্রী।
কারও সঙ্গে ব্যবসায়িক শত্রুতা ছিল কি? প্রশ্ন শুনে কালুর মোড়ের একটি জমির প্রসঙ্গ টেনে অমিত বলেন, ‘‘বছর পাঁচেক আগে এক কাঠা ছয় ছটাকের মতো জমি বাবা কিনলেও জমির মালিক কিছুতেই তার দখল দিচ্ছিলেন না। শেষে বাবা পাঁচ লক্ষ ৭০ হাজার টাকায় অন্য এক জনকে জমি বিক্রি করে দেন।’’ নিহতের ভাই দেবব্রত মণ্ডল বলেন, ‘‘কালুর মোড়ের জমি নিয়ে থানা-পুলিশও হয়েছে।’’
এই সব ঘটনার সঙ্গে খুনের যোগ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। এ দিন চঞ্চলের আর এক ভাই দেবকুমার জানান, শনিবার সকাল সাড়ে ৬টা নাগাদ যে দু’জন এসেছিল, তাদের মধ্যে শ্যামবর্ণ এক জন নিজেকে রফিকুল শেখ বলে পরিচয় দিয়েছিল। আর এক জন নিজের নাম বলেনি। তারা মুর্শিদাবাদের রেজিনগর থানা এলাকায় কাশীপুর মৌজার একটি জমির নকশা করে দিতে বলেছিল চঞ্চলকে। কিন্তু ম্যাপ না থাকায় চ়ঞ্চল কাজ করতে রাজি হননি। ভাইদের সম্পত্তি ভাগের কথা বললে তিনি রফিকুলের মোবাইল নম্বর ও ৫০০ টাকা অগ্রিম নিয়ে রবিবার যোগাযোগ করতে বলেন। তদন্তকারীদের অনুমান, পরিকল্পনা মাফিক রেকি করতেই শনিবার সকালে চঞ্চলের বাড়ি গিয়েছিল আততায়ীরা। রবিবার দুপুরে দেবব্রতের ফোন পেয়ে সন্ধ্যায় রফিকুলেরা তিন জন বাড়িতে আসে। চঞ্চল তখন ছিলেন না। দেবকুমারের কথায়, ‘‘দেবব্রত প্ল্যান দিতে গেলে ওরা বলে, তুমি ছোট, বুঝবে না। দাদাকে ডাকো। দু’বার ফোন করে ডাকার পরে দাদা আসতেই গুলি করে দিল।’’ চঞ্চলকে আততায়ীরা খুনের আগে আরও ৫০০ টাকা দিয়েছিল।
তদন্তকারীদের বক্তব্য, পুরো ঘটনাক্রমের বিবরণে ধোঁয়াশা রয়েছে। দোতলা কাঠের ঘরে চঞ্চল ছাড়া দেবব্রত, তিন জন আততায়ী এবং একটি পর্দার ব্যবধানে অন্য ঘরে নিহতের স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়ে ছিলেন। দেবব্রতের দাবি, নকশা নিয়ে যাওয়ার সময়ে চৌকাঠে দাঁড়িয়ে গুলি করে এক দুষ্কৃতী। তার আগে পর্যন্ত কেউ কোনও আভাস পাননি। পরিবারের এত জনের উপস্থিতিতে দুষ্কৃতীরা কী ভাবে কাজ হাসিল করল, তা ধন্দে ফেলেছে পুলিশকে। স্ত্রী জানিয়েছেন, প্রথমে এক জন ঘরে ছিল। চঞ্চল এলে আরও দু’জন ঢোকে। যদিও পুলিশ জানায়, দুষ্কৃতীরা সংখ্যায় কত জন ছিল, তা তদন্তসাপেক্ষ। কারণ বিভিন্ন সূত্রে যা বয়ান মিলেছে, তা যাচাই করা প্রয়োজন। একই ভাবে দুষ্কৃতীদের শনাক্তকরণ এবং দেবব্রতের সঙ্গে দুষ্কৃতীদের ধস্তাধস্তির বিবরণও আতসকাচের তলায় রয়েছে।
এ দিন ঘটনাস্থল থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা। সেখানে এক আততায়ীর হাতঘড়ি মিলেছে।
এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজও। পুলিশ সূত্রের খবর, নিহতের বাড়ি থেকে চারটি গুলির খোল উদ্ধার হয়েছে। প্রাথমিক বয়ানের ভিত্তিতে দু’জন দুষ্কৃতীকে চিহ্নিতও করা হয়েছে।