আতঙ্ক ছড়িয়েছে গোটা এলাকায়। নিজস্ব চিত্র
ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর বিবাদী বাগ থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত মেট্রো লাইন নিয়ে যাওয়ার জন্য টানেল বোরিংয়ের জেরে বৌবাজার এবং মুচিপাড়া এলাকায় ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল প্রায় ২২ বাড়ি। একাধিক বাড়ির অংশ ভেঙে পড়েছে। মেট্রোর টানেলের জন্য বোরিংকে কেন্দ্র করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে গোটা এলাকায়। পুরসভার পক্ষ থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২৮৪ জনকে বিভিন্ন হোটেলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
শনিবার সন্ধ্যা থেকেই দুর্গা পিথুরি লেন এবং শাঁখারি পাড়া লেনের বাসিন্দারা ভূমিকম্পের মতো কম্পন অনুভব করতে শুরু করেন। রাতেই সেই কম্পনের জেরে একাধিক বাড়ির মেঝে এবং দেওয়ালে বড় বড় ফাটল দেখা যায়। বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়েন এবং হয় আত্মীয় স্বজন নয় তো শিয়ালদহ এলাকার বিভিন্ন গেস্ট হাউসে আশ্রয় নেন।
রবিবার সকাল থেকে সেই কম্পনের মাত্রা আরও বাড়ে বলে অভিযোগ বাসিন্দাদের। সেই সঙ্গে বাড়ির ফাটলের পরিমাণ বাড়তে থাকে। চাঙড় খসে পড়তে থাকে এবং গোটা বাড়ি বিপজ্জনক ভাবে কাঁপতে থাকে। বাসিন্দাদের দাবি, বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার মেট্রো কর্তৃপক্ষের ইঞ্জিনিয়ররা গিয়েছিলেন। তাঁরা কিছু বাড়ি চিহ্নিত করেন এবং কয়েকটি বাড়ির ঝুলন্ত কাঠামোর তলায় লোহার থাম বসিয়ে দিয়ে যান। এক বাসিন্দা বলেন,‘‘মেট্র্রোর ইঞ্জিনিয়ররা জানিয়েছিলেন, সামান্য কিছু ফাটল হতে পারে বাড়িতে। সেই ফাটল তাঁরা সারিয়ে দিয়ে যাবেন।” কিন্তু বাস্তবে সামান্য ফাটলে থেমে থাকেনি। কম্পনের জেরে একাধিক বাড়ির বিভিন্ন অংশ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে রবিবার সারাদিন।
আরও পড়ুনঃ অশালীন মিম! তৃণমূলের অধ্যাপক নেতার বিরুদ্ধে লালবাজারে অভিযোগ বৈশাখীর
আরও পড়ুন: মাথায় আঘাতের চিহ্ন, গল্ফগ্রিনে রাস্তায় যুবকের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার
রবিবার সকাল থেকেই ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি ছাড়েন ওই এলাকার বাসিন্দারা। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে প্রথমে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। দুর্গা পিথুরি লেন এবং শাঁখারি পাড়ার ২২ বাড়ি পুলিশ চিহ্নিত করে বাসিন্দাদের সরিয়ে দেয়। ফাঁকা করে দেওয়া হয় গোটা চত্বর।
বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে এবং পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ঘটনাস্থলে যান সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কলকাতা পুলিশের ডিসি সেন্ট্রাল-সহ পদস্থ কর্তারা। কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘আমাদের মূল কাজ যাতে কেউ ওই বিপজ্জনক বাড়ির মধ্যে বসবাস না করেন। আমরা সমস্ত বাড়ি ফাঁকা করে দিয়েছি। ওই এলাকা ঘিরে দেওয়া হয়েছে।” ঘটনাস্থলে কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং দমকলের বিশেষ বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছে আপৎকালীন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে।
সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, তিনি বেলা ১২টা নাগাদ ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা কেএমআরসি-র জেনারেল ম্যানেজারকে গোটা ঘটনা জানান। সাংসদের দাবি, তার আগে জেনারেল ম্যানেজার পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না।
বিকেলে ঘটনাস্থলে যান মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তিনি বলেন, ‘‘মেট্রো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। টানেলে জল ঢুকে যাওয়ায় বিপত্তি। আমরা বলেছি আপাতত কাজ বন্ধ রাখতে। যেখানে জল ঢুকেছে সেই অংশ আগে তারা কংক্রিট দিয়ে জমাট করবেন।” মেয়র আরও বলেন,‘‘মেট্রো কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে। তাঁরা গোটা এলাকা দেখবেন। তারপর তাঁরা আমাদের জানাবেন ওই জায়গায় বাড়ি করে থাকা কতটা নিরাপদ।”
ঘটনাস্থলে মেয়র ফিরহাদ হাকিম। নিজস্ব ছবি
মেয়র জানিয়েছেন, পুরসভার পক্ষ থেকে ১৮ টি বাড়িকে এ পর্যন্ত বিপজ্জনক চিহ্নিত করা হয়েছে। ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘‘আপাত ভাবে কয়েকদিন বাসিন্দারা আশে পাশের হোটেলে থাকবেন। ভাড়া দেবে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। এরপর সাময়িক ভাবে তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়ার জন্য ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করবে মেট্রো কর্তৃপক্ষ। বোরিংয়ের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যদি বিশেষজ্ঞরা আশ্বাস দেন যে ওই জায়গায় বাড়ি করা নিরাপদ তবে সেখানে মেট্রো কর্তৃপক্ষের অর্থে বাড়ি করে দেওয়া হবে। না হলে অন্য কোথাও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে মেট্রো।”
মেট্রো কর্তৃপক্ষ এ দিন বিকেল পর্যন্ত সরকারি ভাবে কোনও মন্তব্য না করলেও, মেট্রো আধিকারিকদের একাংশ জানিয়েছে, ওই বাড়িগুলির বাসিন্দাদের দীর্ঘদিন ধরেই বাড়ি ফাঁকা করার নোটিস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা শোনেননি। এমন কি বাড়িগুলির অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য ইঞ্জিনিয়ররা সমীক্ষা করতে এলেও সহযোগিতা করেননি ওই বাসিন্দারা। তবে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠায় আপাতত বোরিংয়ের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে মেট্রো সূত্রে।
বাসিন্দাদের বক্তব্য, তাঁরা মেট্রোর কাছ থেকে আগে কোনও নোটিস পাননি। তাঁদের বাড়ির তলা দিয়ে মেট্রো যাবে এমন কোনও তথ্য তাঁরা জানতেন না। মেট্রোর টানেল বোরিংয়ের জন্য যে সমীক্ষা করা হয়েছিল, তাতেই কি গলদ ছিল? এই বিপত্তির পর প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও।