নরেশ ও প্রিয়াঙ্কা। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে পাওয়া ছবি।
গায়ে আগুন দিয়েছিলেন স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে গুরুতর জখম হন জগদ্দলের বাসিন্দা, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর জওয়ান নরেশ পান। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ভর্তি ছিলেন কম্যান্ড হাসপাতালে। গত শনিবার মারা যান প্রিয়াঙ্কা। সেই খবর পেয়ে সে দিনই কীটনাশক খেয়ে আত্মঘাতী হন প্রিয়াঙ্কার মা শিখাদেবী। মঙ্গলবার সকালে মৃত্যু হল ৩০ বছরের নরেশেরও।
একই দিনে বড় মেয়ে ও স্ত্রীর মৃত্যুর পরেও শোক করার সময় পাননি মধ্যমগ্রামের নিমাই ঘোষ। শনিবার সকাল থেকে রবিবার রাত পর্যন্ত ছুটে বেরিয়েছেন বারাসত থেকে কলকাতা, মধ্যমগ্রাম থেকে জগদ্দল। রবিবার রাতে ব্যারাকপুরে পাশাপাশি স্ত্রী ও মেয়ের দেহ সৎকার করে ফিরে আসেন মধ্যমগ্রামে, নিজের বাড়িতে। সেখানে নিমাইবাবুর ছোট মেয়ে স্বর্ণালীর সঙ্গে তখন নরেশ-প্রিয়াঙ্কার সাড়ে আট এবং সাড়ে তিন বছরের দুই ছেলে, সন্দীপ ও সায়ন।
সোমবার সকালে শুরু হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের তোড়জোড়। চার দিনের মাথায় মঙ্গলবার শিখাদেবীর কাজ। সেই আয়োজন করতেই কেটে যায় গোটা দিন। মঙ্গলবার সকালে মধ্যমগ্রামের বাড়িতে স্বর্ণালী যখন সবে মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কাজ শুরু করেছেন, তখনই খবর আসে, নরেশ মারা গিয়েছেন। শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পরে আবার বেরিয়ে পড়েন নিমাইবাবু। মঙ্গলবার রাতে তিনি বলেন, ‘‘কী করব? নরেশের বাবা নেই। শনিবার রাতে ওর মা আরতি পানের নামে আমিই জগদ্দল থানায় অভিযোগ করি। তিনি এখন জেলে। জামাইয়ের বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ ছিল না। ওর দেহ আমি ছাড়া আর কে সৎকার করবে?’’
এ দিন বিকেলে আত্মীয়দের নিয়ে জগদ্দল থানার কুতুবপুরে পৌঁছন নিমাইবাবু। সেখানে স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে রাতে ছোটেন জগদ্দল থানায়। বলেন, ‘‘পুলিশের কাছে আবেদন করে লিখিত অনুমতি নিয়ে আমি বুধবার সকালে জামাইয়ের দেহ নেব।’’ তবে, তার আগে নরেশের ময়না-তদন্ত হবে। দেহ পেতে পেতে বুধবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
নরেশের দেহ কে নেবেন, তা নিয়ে মঙ্গলবার রাত থেকে মতভেদ তৈরি হয়। নরেশের মা আরতি পান রয়েছেন দমদম সেন্ট্রাল জেলে। তাঁকে ছেলের মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে। বাবা নিরাপদ অনেক দিন আগেই সাপের কামড়ে মারা গিয়েছেন। নরেশের দাদা নান্টু বছর দুই আগে কিডনির অসুখে মারা যান। তিনি বিয়ে করেননি। নরেশের স্ত্রী মারা গিয়েছেন শনিবার। তাঁদের দুই সন্তানই নাবালক।
পুলিশ জানিয়েছে, নরেশের কাছের আত্মীয় বলতে রয়েছেন তাঁর একমাত্র বোন নিভা সাহা। দশ বছর আগে তাঁর বিয়ে হয়েছে। থাকেন কৃষ্ণনগরে। প্রিয়াঙ্কার মৃত্যুর পরে নিভার নামেও অভিযোগ জানিয়েছিলেন নিমাইবাবু। তবে, তাঁকে এখনও পুলিশ গ্রেফতার করেনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিভা দাদার দেহ নিতে এলে মানবিকতার খাতিরে আপত্তি করা হবে না বলেও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। তবে, নিভার সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও নম্বর মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। দাদার মৃত্যুর খবর তিনি পেয়েছেন কি না, তা নিয়ে পুলিশও অন্ধকারে।
নরেশের বাড়ি জগদ্দল থানা এলাকার কুতুবপুরে। কাছেই পানপাড়ায় নরেশের কাকারা থাকেন। আরতিদেবীকে এক দিনের জন্য প্যারোলে মুক্তি দিতে বুধবার সকালে নরেশের কোনও এক কাকাকে দিয়ে আদালতে আবেদন করানো হতে পারে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। আরতিদেবী বেরিয়ে ছেলের দেহ সৎকার করবেন।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় পানপাড়ায় গিয়ে যোগাযোগ করা হয় নরেশের ছোট কাকা সুপ্রকাশ পানের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, তাঁরা সাত ভাই। তাঁদের মধ্যে এক ভাই সুশান্ত পান পরশু মারা গিয়েছেন। তাঁরা এখন সেই সব বিষয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। তাই তাঁদের কারও পক্ষে বুধবার সকালে আদালতে গিয়ে আরতিদেবীর প্যারোলের জন্য আবেদন করে, তাঁকে সেখান থেকে বার করে এনে নরেশের দেহ সৎকার করানো সম্ভব নয়।
সুপ্রকাশবাবুর অভিযোগ, আরতিদেবীর জন্যই নিরাপদবাবুর সঙ্গে তাঁর আত্মীয়স্বজনের সম্পর্কে ছেদ পড়েছিল। তা-ও বছর তিরিশ আগে। তিনি জানান, এক সময়ে পানপাড়ায় থাকতেন নিরাপদ। কিন্তু, আরতিদেবীকে নিয়ে চলে যান কুতুবপুরে। তবে, ভাইপো নরেশের সঙ্গে সুপ্রকাশবাবুর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আগুন লাগার ঘটনা ঘটার আগের দিন কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ের কাছে নিজের কেনা জমিতে গিয়েছিলেন নরেশ। সুপ্রকাশবাবুও সঙ্গে ছিলেন। চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই জমিতে ব্যবসা করার পরিকল্পনা করছিলেন নরেশ — জানিয়েছেন সুপ্রকাশবাবু।
কলকাতার আরও খবর পড়তে চোখ রাখুন আনন্দবাজারে।