হাঁটু, নিতম্ব, কোমর ও ঘাড়ের হাড় কিংবা মেরুদণ্ড প্রতিস্থাপনের মতো যাবতীয় বড় অস্ত্রোপচার বন্ধ। এক জনও সার্জন নেই।
অভিযোগ, নাম-কা-ওয়াস্তে শুধু প্লাস্টারের মতো সামান্য চিকিৎসাই হচ্ছে। জটিল কেস এলে আউটডোর থেকেই রোগীদের বিদায় করা হচ্ছে। ফলে ভাঙা হাত বা পা ঠিক করার যে অস্ত্রোপচার ২-৩ হাজার টাকায় করা যেত, সেটা বেসরকারি জায়গায় ২০-২৫ হাজার টাকায় করাতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
বিকলাঙ্গদের জন্য কৃত্রিম হাত, পা, ক্র্যাচ, ক্যালিপার, হুইলচেয়ার তৈরি তলানিতে ঠেকেছে। মাসের পর মাস হত্যে দিয়ে থাকা প্রতিবন্ধীর সংখ্যা তিন হাজার পেরিয়ে গিয়েছে। প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মাত্রা মাপার কাজও বন্ধ।
ফিজিওথেরাপি বিভাগে অধিকাংশ পদ খালি হয়ে যাওয়ায় সেখানে কাজও যে কোনও দিন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা। কোনও রেডিওলজিস্ট নেই। ফলে অধিকাংশ রোগীর এক্স-রে হয় না। যদিও বা কারও হয়, তাঁদের হাতে লিখিত রিপোর্ট দেওয়া হয় না।
গত তিন মাস ধরে রাজ্যে অস্থি-সংক্রান্ত চিকিৎসার একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারি হাসপাতাল ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অর্থোপে়ডিক্যালি হ্যান্ডিক্যাপ়ড’ (এনআইওএইচ)-এর চেহারাটা এমনই। বড় অস্ত্রোপচার ২০১১-১২ সালে যেখানে ছিল ২৫০, তা কমতে কমতে ২০১৪-১৫ সালে এসে দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশে। কৃত্রিম হাত-পা ও ক্যালিপার তৈরি ১১৬৫ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৫৯৮-এ। অথচ এই হাসপাতালেই ২০১৪-১৫ সালে রোগী এসেছেন ৪৮ হাজার।
যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে অস্থির আঘাতজনিত চিকিৎসার জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র স্তরে আর কোনও সরকারি হাসপাতাল নেই, তাই বনহুগলির এই ৬০ শয্যার হাসপাতালই ছিল একমাত্র ভরসা। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে নকল হাত-পা দেওয়ার একটি কেন্দ্র ছিল। সেটিও এখন কার্যত ডকে উঠেছে। এই অবস্থায় এনআইওএইচ-এর পরিষেবার এমন শোচনীয় অবস্থায় দিশাহারা হচ্ছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দরিদ্র রোগীরা। সেখানে তাঁদের তুমুল হেনস্থা হতে হয়েছে বলে একের পর এক অভিযোগ দায়ের হচ্ছে সমাজকল্যাণ দফতর, রাজ্য প্রতিবন্ধী কমিশনার ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।
এই অভিযোগকারীদেরই এক জন হাওড়ার শ্যামপুর থানা এলাকার বাসিন্দা মামণি খাতুন। বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী মামনির ডান পা ছোটবেলা থেকেই পোলিও-আক্রান্ত। ক্যালিপার পরে তিনি হাঁটতেন। ক্যালিপার খারাপ হয়ে যাওয়ায় মাস তিন আগে এনআইওএইচ-এ ভর্তি হন। মামণির অভিযোগ, ‘‘এক মাসের উপর কোনও চিকিৎসা না করে আমায় হাসপাতালে ফেলে রাখা হল। তার পরে ভুল মাপের একটা ক্যালিপার পরিয়ে জোর করে হাঁটাতে গিয়ে টেকনিশিয়ানেরা ডান পা ভেঙে দিলেন। কোনও সার্জন ছিলেন না দেখার জন্য। এর পরেও আমায় এক্স-রে না করে দু’দিন ফেলে রাখলেন। যন্ত্রণায় শুধু চিৎকার করেছি আর বারবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি।’’ তাঁর অভিযোগ, এই চিকিৎসা বিভ্রাটের জন্য এখন ক্যালিপার নিয়েও হাঁটতে পারেন না।
আর এক অভিযোগকারী উত্তর ২৪ পরগনার শাসনের বাসিন্দা সরোজকুমার পাল। তাঁর একটি পা পোলিও আক্রান্ত। ২০১০ সালে এনআইওএইচ থেকেই ক্যালিপার তৈরি করেছিলেন। সেটি খারাপ হয়ে যাওয়ায় নতুন ক্যালিপারের জন্য গত দেড় বছর ধরে হাসপাতালে ঘুরছেন। আজ পর্যন্ত তা পাননি। ক্যালিপারের অভাবে তিনিও প্রায় গৃহবন্দি।
কেন এই অবস্থা? জানতে চাওয়ায় হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত অধিকর্তা অভিষেক বিশ্বাস বলেন, ‘‘সার্জন নেই। দিল্লিকে জানিয়েছি। না দিলে আমাদের কিছু করার নেই।’’ কৃত্রিম হাত-পা তৈরির কাজও প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে কেন? তাঁর মন্তব্য, ‘‘কোনও কৈফিয়ত দেব না। আমরা যা করার করছি।’’
হাসপাতালের এক প্রবীণ চিকিৎসকের অবশ্য আফশোস, ‘‘১০-১৫ বছর আগেও অস্থির চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারে এই হাসপাতাল ছিল রাজ্যে এক নম্বর। গত এক বছর ধরে বোন গ্রাফটিং, হিপ-নি রিপ্লেসমেন্ট, অ্যাম্পুটেশনের মতো অস্ত্রোপচার কিচ্ছু হচ্ছে না। আউটডোরে ইঞ্জেকশন দিয়ে হাঁটু থেকে জল বার করা বা বেঁকে যাওয়া পায়ের পাতা সোজা করার মতো সামান্য বিষয়গুলিকে অস্ত্রোপচার বলে তালিকাভুক্ত করে কেন্দ্রের চোখে ধুলো দেওয়া হচ্ছে। সদ্যপ্রাক্তন এক চিকিৎসকের অভিযোগ, হাসপাতালের কর্তা আর চিকিৎসকদের একাংশই চান না যে, হাসপাতাল ভাল ভাবে চলুক। বরং খারাপ চললে তাঁরা রোগীদের বেসরকারি জায়গায় পাঠিয়ে কমিশন লুটতে পারেন। কেন্দ্র স্পাইন্যাল কর্ড ওয়ার্ড তৈরির জন্য পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। তাও সঠিক সময়ে ব্যবহার না করায় টাকা ওড়িশার এনআইওএইচকে দিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ ওই চিকিৎসকের।
এনআইওএইচ হল সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন মন্ত্রকের আওতাধীন। ওই মন্ত্রকের প্রতিবন্ধী ক্ষমতায়ন বিভাগের এক যুগ্ম সচিবের কথায়, ‘‘ওই হাসপাতালের সমস্যা জানি। যেহেতু সার্জনের ব্যবস্থা করতে হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে, তাই স্বাস্থ্য ও সামাজিক ন্যায় এই দুই মন্ত্রকের সমন্বয় সাধনে একটু সময় লাগছে।’’ তিনি আরও জানান, ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস’ (এইমস) যাতে এনআইওএইচ অধিগ্রহণ করে, সে জন্য হাসপাতালকর্মীদের কয়েক জন অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এইমস কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হননি।