গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে উত্তপ্ত কাশীপুরে পুলিশি টহল। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
শিয়রে পুরভোট। তার ঠিক আগে, নববর্ষের দুপুরে শাসকদলের দুই গোষ্ঠীর তাণ্ডব দেখল খাস কলকাতা।
ঘটনাস্থল: কাশীপুর। সেখানকার উদ্যানবাটী এলাকায় বুধবার ভরদুপুরে মুড়ি-মুড়কির মতো ইট, বোমা পড়ল। এমনকী, গুলিও চলল বৃষ্টির মতো। দিশেহারা পথচারীরা যে যে দিকে পারলেন, ছুটে পালালেন। কেউ কেউ দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন লাগোয়া বস্তির ঘরে। বিপদ বুঝে উদ্যানবাটীর নিরাপত্তারক্ষীরাও তড়িঘড়ি গেট বন্ধ করে তালা ঝুলিয়ে দিলেন।
বাংলা বছরের শেষ দিনটায় কলকাতার পুরভোট-আবহ সরগরম হয়ে উঠেছিল বিরোধীদলের এক নেত্রীর উপরে শাসকদলের হামলা ঘিরে। আর নতুন বছরের প্রথম দিনে কলকাতা এ ভাবে রক্তাক্ত হল শাসকদল তৃণমূলেরই দুই গোষ্ঠীর টক্করে। যাতে এ দিন দু’জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁরা আরজিকরে ভর্তি। পুলিশের হিসেবই বলছে, প্রায় তিরিশ রাউন্ড গুলি চলেছে। বোমা পড়েছে সাতটি। ঘণ্টাখানেক ইট বিনিময় হয়েছে।
এবং এ ক্ষেত্রে তিরের মুখে কলকাতা পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূল প্রার্থী সীতা জয়সোয়ারা ও বিক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতা, তথা ওই ওয়ার্ডের নির্দল প্রার্থী জয়নাল আবেদিন। বস্তুত তৃণমূলের অন্দরের খবর, পুরভোট যত এগিয়ে আসছে, কলকাতার নানা ওয়ার্ডে ততই তীব্র হচ্ছে শাসকদলের গোষ্ঠী-বিবাদ। ‘‘কাশীপুরে লড়াইটা সেয়ানে-সেয়ানে। তাই আওয়াজ পাওয়া গেল। অনেক জায়গায় নিঃশব্দে সন্ত্রাস চলছে।’’— মন্তব্য এক তৃণমূল নেতার।
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য এই অভিযোগ ফুৎকারে ওড়াচ্ছেন। দলের উত্তর কলকাতা জেলা সভাপতি তথা সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় কাশীপুর-কাণ্ডকে তাঁদের দলের ব্যাপার হিসেবেই মানতে নারাজ। সুদীপবাবুর কথায়, ‘‘আমি শুনেছি, এক জন নির্দল প্রার্থীর লোকজন ওখানে গোলমাল করেছে। পুলিশকে বলেছি অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে। স্বাভাবিক জনজীবনকে যারা ব্যাহত করতে চাইছে, শক্ত হাতে তাদের মোকাবিলা করতে হবে।’’ যদিও স্থানীয় তৃণমূলেরই একাংশের দাবি, নির্দল প্রার্থী জয়নাল দলের স্থানীয় নেতা মহম্মদ আনোয়ার খানের ঘনিষ্ঠ। তৃণমূলের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডের অনুগামী আনোয়ার প্রকাশ্যে জয়নালের পিছনে না-থাকলেও তাঁর লোকজন নির্দল প্রার্থীর সঙ্গেই আছে। স্থানীয় তৃণমূল সূত্রের খবর, ওই ওয়ার্ডে দলের সভাপতি এবং যুব ও মহিলা তৃণমূলের সভাপতিরাও জয়নালকে সমর্থন করছেন।
এ সব মিলিয়ে ১ নম্বরে শাসক দলের গোষ্ঠী-কোন্দল তুঙ্গে। গত বরিবারেও জয়নালের বাড়ির সামনে সীতা-অনুগামী স্বপন চক্রবর্তীর সাঙ্গোপাঙ্গরা বোমা ছোড়ে বলে অভিযোগ। সেই ঘটনায় দু’জন আহত হন। তার পরে এ দিন দুপুরের ঘটনা।
পুলিশ-সূত্রের খবর: আনোয়ার শিবিরের তৃণমূলকর্মী পাপ্পু সিংহ ওখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। অভিযোগ, সীতা-অনুগামী স্বপন চক্রবর্তী তাঁকে পিস্তল উঁচিয়ে শাসায়। পাপ্পু আবার সম্পর্কে উত্তর ২৪ পরগনার তৃণমূল নেতা অর্জুন সিংহের ভাগ্নে। তিনি ঘটনাটি গিয়ে জানান স্থানীয় তৃণমূল নেতা নন্দলাল সাউকে। নন্দলাল কাশীপুর থানায় নালিশ করেন। পুলিশ স্বপনকে ডেকে সাবধান করে দেয়। তখন দুপুর একটা।
এর পরেই ধুন্দুমার বেঁধে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পুলিশ খবর পেয়েছে শুনে জনা ষাটেক ছেলে নিয়ে কাশীপুর উদ্যানবাটী এলাকায় চড়াও হয় স্বপন। উদ্যানবাটীর উল্টো দিকের বস্তিতে আনোয়ারের ডেরা, এবং তাঁর বাড়িই হামলাকারীদের ‘টার্গেট’ ছিল বলে অভিযোগ। আনোয়ারের বাড়ি লক্ষ্য করে যথেচ্ছ ইট, বোমা পড়তে থাকে। বস্তির আশপাশের ঘরও রেহাই পায়নি। স্থানীয় সূত্রের খবর, কয়েক মাস আগে স্বপনদের সঙ্গে আনোয়ারের বড় ঝামেলা বেঁধেছিল, যার পরে পুলিশি অনুমতি নিয়ে আনোয়ারের বাড়ির সামনের ফুটপাথে সিসিটিভি বসানো হয়। হামলার শুরুতেই আক্রমণকারীরা সেই ক্যামেরা ভেঙে দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ঘণ্টাখানেক ধরে পুলিশের সামনেই তাণ্ডব চলে। ‘‘ওরা পিস্তল হাতে নিয়ে ঘুরছিল। পুলিশ দেখেও দেখেনি।’’— বলেন এক বাসিন্দা। তবে কলকাতা পুলিশের ডিসি (নর্থ) বাস্তব বৈদ্যের দাবি, ‘‘সমাজবিরোধী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বোমাবাজি হয়েছে। তদন্ত চলছে। কারা হামলা চালাল, তা চিহ্নিত করার চেষ্টা হচ্ছে।’’ ডিসি’র কথায় গুলিচালনার উল্লেখ না-থাকলেও পুলিশের অন্য এক আধিকারিক জানিয়েছেন, প্রায় তিরিশ রাউন্ড গুলি চলেছে।
ঘটনার প্রতিবাদে সন্ধ্যায় আনোয়ারেরা কাশীপুর থানা ঘেরাও করে পুলিশকে স্মারকলিপি দেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে স্বপনকে গ্রেফতারের দাবি করেছেন তাঁরা। ফোনে আনোয়ার বলেন, ‘‘এ ভাবে এখানে শান্তিপূর্ণ ভোট হওয়া অসম্ভব। সীতা জয়সোয়ারারা গুন্ডামি করে জিততে চাইছে।’’ হামলার সময়ে তিনি তৃণমূল ভবনে ছিলেন বলে জানিয়েছেন আনোয়ার। তাঁর অনুগামী তথা নির্দল প্রার্থী জয়নাল বলেন, ‘‘আসলে আমাকে জব্দ করতেই সীতার হয়ে স্বপনেরা গণ্ডগোল পাকাচ্ছে।’’ অন্য দিকে সীতা জয়সোয়ারার পাল্টা দাবি, ‘‘আনোয়ারেরাই এই তল্লাটে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে।’’ তৃণমূল প্রার্থীর অভিযোগ, আনোয়ারের সঙ্গীরা এ দিন তাঁর এক সমর্থককে বোমা মেরে দোকান ভাঙচুর করেছে।
সব মিলিয়ে ঘটনার জেরে এ দিন সন্ধে থেকে কাশীপুর থমথমে। পশ্চিমবঙ্গে পালাবদলের পরে শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ভোটের আবহ উত্তপ্ত হওয়াটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময়ে তৃণমূলের বিক্ষুব্ধ প্রার্থীদের ‘শিক্ষা দিতে’ দলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল বাড়িতে আগুন লাগানো এবং বোমা মারার ডাক দিয়েছিলেন। এই পুরভোটের আগেও কলকাতা ও লাগোয়া শহরতলি বারবার তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বকলহে তপ্ত হয়ে উঠেছে।
উত্তাপের আঁচ সবচেয়ে বেশি পোহাচ্ছে উত্তর কলকাতাই। বিশেষত ১ এবং ২ নম্বর বরোর ৪-৫টি ওয়ার্ড। ২ নম্বর এ বার মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় সেখানকার দলীয় কাউন্সিলর শান্তনু সেনকে সরানো হয়েছে তিন নম্বরে, যার সুবাদে তিন নম্বরের কাউন্সিলর ব্রজেন্দ্র বসু বাদ পড়েছেন। স্থানীয় তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা এতে যারপরনাই ক্ষুব্ধ। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে দরবারও করেছেন তাঁরা। আবার ২ নম্বরে শান্তনুর জায়গায় প্রার্থী হয়েছেন যিনি, ৪ নম্বরের সেই বিদায়ী কাউন্সিলর পুষ্পালি সিংহকে স্থানীয় তৃণমূলের একাংশ মেনে নিতে পারছে না। একই ভাবে কংগ্রেস থেকে দলবদল করে আসা সুমন সিংহ এ বারও ৬ নম্বরে তৃণমূল প্রার্থী হওয়ায় বিক্ষোভ প্রকট। ১৭ নম্বরে টিকিট না-পেয়ে দলীয় প্রার্থী তথা চক্ষু চিকিৎসক পার্থপ্রতিম হাজারির বিরুদ্ধে নির্দল হয়ে লড়ছেন তৃণমূলের একদা ব্লক কংগ্রেস সভাপতি মোহন গুপ্ত স্বয়ং। মোহনকে এ জন্য দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও রাজ্যের এক মন্ত্রী তাঁকে মদত দিয়ে যাচ্ছেন বলে দলের অন্দরের খবর।
আর স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই সব প্রতিকূলতা মোকাবিলায় শাসকদল এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করছে। বিরোধীরাও সরব। এ দিনের কাশীপুর-কাণ্ড প্রসঙ্গে বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এরই নাম তৃণমূল! শুধু বিরোধীদের নয়, তৃণমূলের হাত থেকে তৃণমূলকে বাঁচানোর জন্যও কেন্দ্রীয় বাহিনী দরকার!’’ সিপিএমের রবীন দেব বলেন, ‘‘তৃণমূল যতই সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, ততই সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করছে।’’ ভোটের দিন বহিরাগত দুষ্কৃতীদের আটকাতে কলকাতা-সংলগ্ন জেলার সীমানা ‘সিল’ করার দাবিও তুলেছেন রবীনবাবু। কংগ্রেসের উত্তর কলকাতার কো-অর্ডিনেটর তারক পালের প্রশ্ন, ‘‘ভোটের তিন দিন আগেই এমন গণ্ডগোল! ভোটের দিন কী হবে?’’