প্রতীকী ছবি।
মানুষ তাঁর কাজের জন্য মনে থেকে যান। চেহারায় নয়। তাই তাঁর কুচকে যাওয়া হাতের স্পর্শ আমার কাছে ঈশ্বরের সমান। শরীরটা তাঁর মাটিতে মিশেছে কবেই। কিন্তু স্কুলে পড়ার সূত্রে সান্নিধ্য পাওয়া মাদার টেরিজ়ার কথা ভাবলে আজও মনে হয়, ঈশ্বরকে ছুঁয়ে নিয়েছি। সাদা-কালো, মোটা-রোগা, বেঁটে-লম্বা— আদৌ কোনও মানুষকে হৃদয়ে ধরে রাখার মাপকাঠি হতে পারে না। যেমন, অনেক সুন্দর চেহারার আড়ালেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যায়। নিজে মোটা বলে অজুহাত নয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।
বিশ্বাস করি, মানুষকে কাজ করে যেতে হবে। যে কোনও কাজ, যেটায় তিনি স্বচ্ছন্দ বা পারদর্শী। এর জন্য তাঁকে পরিশ্রম করতে হবে। সেই জন্য প্রয়োজন সুস্থ থাকা। রোগা, মোটা বা মাঝারি যেমনই হও, তা নিয়ে যেন আত্মবিশ্বাস থাকে। আত্মবিশ্বাস তখনই থাকবে, যখন নিজের অসুস্থতা কাজে কোনও খামতি হতে দেবে না। তাই সুস্থ থাকার জন্য শারীরচর্চা করা উচিত, অন্যের চোখে আকর্ষণীয় হতে নয়। আমি স্বভাবে কুঁড়ে। যে কারণে নিয়মিত ব্যায়াম করা হয় না। অথচ আমার মা নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। আমার বর সপ্তর্ষি তো গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত— বছরের বারো মাস ভোর সাড়ে পাঁচটায় উঠে শারীরচর্চা করে। আমি পারি না। তাই লজ্জিত। এখনও কোনও রোগ নেই মানে এ নয় যে পরেও শারীরিক সমস্যা হবে না!
তবে আমাকে দেখে কে কী বলল, তা নিয়ে ভাবিনি, আজও ভাবি না, কালও ভাবব না। জেনে বা না-জেনে আমরা অনেকেই ‘বডি শেমিং’ করি। সুন্দর চেহারা দেখে চট করে মুগ্ধ হওয়া, বেশির ভাগ মানুষেরই চরিত্র। কেউ সে রকম চটকদার বা ঝকঝকে চেহারার না হলে, অনেকেই তাঁকে জাস্ট পাত্তা দিই না। যাঁরা ফর্সা-কালো, বেঁটে-লম্বা, রোগা-মোটার উপর নির্ভর করে মোহগ্রস্ত হন, তাঁদের সেই প্রবণতাকেই ‘বডি শেমিং’ বলব।
মা-বাবা, মাম্মি-বাবাই, সপ্তর্ষি এবং অনিন্দিতা, অর্ঘ্য-সহ আমার নান্দীকার পরিবার ও বন্ধুদের থেকে কখনও চেহারা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য শুনতে হয়নি। তেমন পরিবেশ পাইনি বা বেছেও নিইনি। বরাবর আমার বড় বুক নিয়ে বুক চিতিয়ে চলেছি। টমবয় স্বভাবের চওড়া কাঁধের সোহিনীর বন্ধুত্ব বেশি হত ছেলেদের সঙ্গেই। মারপিট করে বেড়ে উঠেছি। অ্যাসেম্বলি অব গড চার্চ স্কুলে পড়তাম। বাস্কেটবল খেলতাম। স্কুলের ভাইস ক্যাপ্টেন ছিলাম। লম্বা-চওড়া চেহারার জন্য বন্ধুদের থেকে কখনও খারাপ মন্তব্য শুনিনি। নিজেকে মোটা বলে ভাবতামও না। তবে অসম্ভব ডানপিটে হওয়ায় প্রায়ই স্কুলে বাবা-মায়ের ডাক পড়ত।
একটা অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। তখন বড় হচ্ছি। হাতিবাগান দিয়ে হেঁটে যেতে গিয়ে কেউ আমাকে আন্টি ডেকেছিল। অবাক হয়ে ভেবেছিলাম, কেন আন্টি বলল? দিদিমা বলেছিলেন, ‘তুই তো ছোট থেকেই খুব ডেভেলপড, তাই।’ দিদিমার কথায় কিন্তু কষ্ট পাইনি একটুও। আমাকে ঘিরে এমনই সব মানুষ ছিলেন বা আছেন, যাঁরা স্বাস্থ্যের কথা ভেবে স্নেহমাখা শাসনে হয়তো ওজন কমানোর পরামর্শ দেন।
সপ্তর্ষির সঙ্গে বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে এক দিন ওদের বাড়িতে যাই। ওর ৮৯ বছরের ঠাকুরমাকে বলি, আমি মোটা, সপ্তর্ষির থেকে বয়সে বড় এবং বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। শুনে তিনি বললেন, ‘আমার মায়ের মা ফরিদপুরে মেয়েদের ম্যাগাজিন চালাতেন। সুতরাং এই ধরনের কথা আর বলবে না। তোমাদের যদি মনের দিক থেকে প্রেম হয়ে থাকে, সেটা ঈশ্বর করিয়েছেন। আমাদের কারও হাত নেই।’ এমন মানুষদের আশপাশে থেকে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে।
‘বডি শেমিং’ বা ‘ট্রোলিং’ যাঁরা করেন, তাঁদের জন্য করুণাই হয়। ওঁদের নিজের জন্য কিছু করার নেই, তাই অন্যের পিছনে সময় নষ্ট করেন। আমার প্রচুর কাজ। সকাল থেকে মিটিং, ছ’টি সন্তানসম সারমেয়র দেখাশোনা, বরের সঙ্গে প্রেম, বন্ধুর মতো শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে খুব ভাল আছি। কাজ করে রোজগার করি, সেই টাকায় কর দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোই। কে, কোথায় আমাকে নিয়ে কী বললেন, শোনার সময়ই নেই। নিজেকে কিছুর শিকার হতে দেবেন না। আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করুন। জীবনটা খুব ছোট। সময় কম, কিন্তু অনেক কাজ আছে।