প্রতীকী ছবি।
সন্তানের জন্য দ্রুত দু’ইউনিট রক্ত চাই। এই অবস্থায় রক্ত দিতে পারবেন এমন কারও খোঁজে সারা কলকাতা চষে ফেলেছিলেন হালিশহর থেকে আসা এক থ্যালাসেমিয়া রোগীর মা-বাবা। প্রায়ই রক্তের দরকার হয় বলে মানিকতলার সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে ওই মেয়ের নাম নথিভুক্ত করানো রয়েছে। তবু তাঁদের বলা হয়েছে, “রক্তদাতা আনুন। রোগী যেমনই হোক, দাতা ছাড়া কাউকেই রক্ত দেওয়া হচ্ছে না!” দু’মাস অন্তর রক্ত লাগে যার, তার জন্য চাইলেই রক্তদাতা পাওয়া কি মুখের কথা? হন্যে হয়ে ঘুরে শেষে হালিশহর থেকেই রক্তদাতাকে খুঁজে আনতে গিয়েছে ওই পরিবার।
এই মুহূর্তে শহর জুড়ে এমনই রক্তের আকাল যে, থ্যালাসেমিয়ার মতো জরুরি রোগীদেরও রক্ত পেতে রক্তদাতা নিয়ে আসতে বলা হচ্ছে বলে অভিযোগ। সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে ১২ মাসের রক্তের প্রয়োজনের কথা জানিয়ে নাম লেখানো থাকলেও সুরাহা মিলছে না। আবার রক্তদাতা মিললেও এই ধরনের রোগীদের জন্য তৈরি ডে-কেয়ার ইউনিটের সুবিধা মিলছে না। অভিযোগ, একই অবস্থা মেডিক্যাল কলেজগুলির ব্লাড ব্যাঙ্কেরও।
রক্তদান আন্দোলন কর্মসূচির সঙ্গে যুক্তেরা জানাচ্ছেন, রোগ ধরা পড়ার পরেই শহরের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে রোগীর নাম নথিভুক্ত করানো যেতে পারে। যে হেতু এই ধরনের রোগীদের কারও মাসে এক বা দু’ইউনিট, কারও বা মাসে দু’-তিন বার দুই বা তারও বেশি ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হয়, ফলে নাম লেখানো থাকলে এত দিন তাঁরা এলেই রক্ত দেওয়া হত। এর জন্য ছিল ডে-কেয়ার ইউনিটও। যেখানে একাধিক শয্যা থাকে, কিন্তু সেখানে ভর্তির ব্যাপার থাকে না। নাম নথিভুক্ত থাকা রোগী এলে ওই শয্যায় শুইয়ে রক্ত দেওয়া হয়। তার পরে কয়েক ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রেখে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সঙ্গে করে রক্তদাতাকে না নিয়ে এলে এই ডে-কেয়ার ইউনিট ব্যবহারের সুযোগও পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রতি মাসে দু’বার দু’ইউনিট করে রক্ত লাগে সোদপুরের সুবিমল ঘোষের। তিনি বলছেন, “সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে নাম লেখানো আছে। অথচ গত মাসেই বলেছিল, দাতা না আনলে রক্ত দেওয়া হবে না। কলকাতায় কাউকে পাইনি। পরে সোদপুর থেকে দু’জন দাতাকে নিয়ে গিয়ে দু’ইউনিট রক্ত পেয়েছি। এ মাসেও একই কথা বলেছে। ট্রেন বন্ধ বলে এখন কেউ যেতেও চাইছেন না। জানি না কী করব!” একই অবস্থা হৃদয়পুরের কিশোরী সুমনা সাহার। তার বাবা বললেন, “কোনও মতে অসুস্থ মেয়েকে বাসে করে এন আর এসে নিয়ে গিয়েছিলাম। রক্তদাতা নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু বাসে যাওয়ার ভয়েই কেউ যেতে চাইছেন না।” সরকার কেন এই বিষয়ে নজর দিচ্ছে না, সেই প্রশ্নও তুলছেন তিনি।
স্বাস্থ্য দফতরের তরফে অবশ্য জানানো হচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিরও হাত-পা বাঁধা। অতিমারি পরিস্থিতিতে রক্তদান শিবির কার্যত বন্ধ থাকায় ব্যাপক রক্তের আকাল তৈরি হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই শিবিরের পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা বাতিল হচ্ছে। রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অচিন্ত্য লাহা বললেন, “এর সবচেয়ে বড় কারণ কোভিডের ভয়। শিবিরের উদ্যোক্তারাই বহু ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছেন। মানুষও ভয়ে রক্তদানের পথে এগোচ্ছেন না। কিন্তু সবরকম নিয়ম ও দূরত্ব-বিধি মেনে এই ধরনের রক্তদান শিবিরগুলি কতটা জরুরি, সেটা সকলকেই বুঝতে হবে।” রক্তদান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের আরও দাবি, আগে শিবিরে রক্ত দিলে একটি করে কার্ড মিলত, যা ব্লাড ব্যাঙ্কে দেখালে অন্তত এক ইউনিট রক্ত মিলত। কিন্তু বহু দিন থেকেই রক্তের আকালের জেরে কার্ড দেখালেও দাতা নিয়ে আসতে বলা হচ্ছে। যেমন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের শিবিরে রক্তদান করে কার্ড পেলেও তাঁকে সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্কে গিয়ে কার্ড দেখানোর কথা বলছে ওই হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক। ফলে রক্তদানে আগ্রহ হারাচ্ছেন কেউ কেউ।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কী করবেন রোগীরা? রাজ্য রক্ত সঞ্চালন পর্ষদের যুগ্ম অধিকর্তা (ব্লাড সেফটি) গোপালচন্দ্র বিশ্বাস বললেন, “সকলকে কার্ডের বিনিময়ে রক্ত দেওয়া শুরু করলে যেটুকু রক্ত ব্লাড ব্যাঙ্কগুলিতে আছে তা-ও শেষ হয়ে যাবে। নতুন রক্ত পাওয়া যাবে না। তবে একেবারে নিরুপায়দের কার্ডের বিনিময়ে রক্ত দিতে বলা হয়েছে। ঘাটতি মেটাতে পুলিশের সঙ্গে কথা হয়েছে। রাজ্য জুড়ে পুলিশের তরফে রক্তদান কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।”
থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তদের নিয়ে তৈরি একটি সংগঠনের অন্যতম সদস্য সুমিতা সমাদ্দার যদিও বললেন, “আমরাও সংস্থা বানিয়ে চেষ্টা করছি। সকলে সচেতন ভাবে এগিয়ে না-এলে কিন্তু এই ছেলেমেয়েদের মুখে হাসি ফুটবে না। মনে রাখতে হবে, রক্তই কিন্তু অনেকের জীবন।”