BJP

এক দিকে ‘সাপ-নেউল’, অন্য দিকে থিম ‘ঐক্য’, বিজেপির শিবিরে তিন দিনে কে কোন খেলা খেললেন?

রাজ্য বিজেপির প্রশিক্ষণ শিবির হয়ে গেল কলকাতায়। সেই শিবিরে কী হবে আর কেমন করে হবে তার সবটাই ঠিক হয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশ মতো। লক্ষ্য, রাজ্য নেতৃত্বের ‘অসুখ’ সারানো।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:২১
Share:

শিবিরের ফাঁকে ঐক্যের গ্রুপ ফোটো। — নিজস্ব চিত্র।

সুকান্ত মজুমদারকে পিছন থেকে জাপটে ধরেছেন হিরণ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর পিঠে বুক ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন অশোক লাহিড়ি। এই ভাবে তৈরি হয়েছে সাংসদ, বিধায়ক, নেতাদের লম্বা শৃঙ্খল। ধরা যাক, মাঝে রয়েছেন দিলীপ ঘোষ আর শৃঙ্খলের বাইরে সৌমিত্র খাঁ। এ বার দিলীপের গায়ে হাত ঠেকাতে হবে বিষ্ণুপুরের সাংসদকে। ওই শৃঙ্খলের নাম ‘সাপ’। আর বাইরে যিনি রয়েছে তিনি ‘নেউল’। নেউল সাপের মধ্যে থাকা নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তিকে ছুঁয়ে দিলেই তিনি নেউল হয়ে যাবেন। কিন্তু শৃঙ্খলের সবাই বাঁচাতে চাইবেন ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে। এই খেলার নাম, ‘সাপ-নেউল’। রাজ্য বিজেপির নেতাদের মধ্যেকার ‘সাপে নেউলে’ সম্পর্ক মেটাতে এটা ছিল বৈদিক ভিলেজে হওয়া তিন দিনের প্রশিক্ষণ শিবিরে এটাই ছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য খেলা।

Advertisement

রাজনৈতিক দলের শিবির মানেই সেখানে খালি গুরুগম্ভীর আলোচনা। একের পর এক বক্তা বলেই চলেছেন বিভিন্ন বিষয়ে। কিন্তু সেটা যাতে একঘেয়ে না হয়ে যায় তার জন্য কখনও খেলা, কখনও গান, কখনও যোগাভ্যাসের আয়োজন ছিল। ২৯ থেকে ৩১ অগস্টের শিবিরে সব আয়োজনই বাঁধা ছিল এক থিমে। সেই থিমের নাম— ‘ঐক্য’। অনেক দিন ধরেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা লক্ষ্য করেছেন, রাজ্য দলে সবার আগে দরকার মিলমিশ। সকলে একসঙ্গে চলার শিক্ষা। সেই কারণেই নাকি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বাংলার প্রশিক্ষণ শিবিরের থিম ঠিক করে দিয়েছিলেন।

শিবিরের শেষে সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ এক রাজ্য বিজেপি নেতা বলেন, ‘‘আরএসএস-এর শিবিরের অনুকরণেই হয় আয়োজন। সবার সঙ্গে সবার সম্পর্ক থাকলেও কেউ তো আর কারও গায়ে গা লাগিয়ে থাকতে পারেন না এমনি সময়ে। তাই এমন সব খেলার আয়োজন হয়েছিল যাতে গায়ে-গায়ে লেগে থাকা যায়। সংগঠন গড়ার এই শিক্ষা দিতেই বাছা হয়েছিল এমন অনেক খেলা।’’ জানা গিয়েছে, শিবিরে ফুটবল খেলাতেও মেতেছিলেন বিজেপি নেতারা। একা একা গোলের দিকে বল না নিয়ে গিয়ে যাতে একে অন্যকে পাস বাড়িয়ে দেন সেটা শেখানোই ছিল যার লক্ষ্য, যা ইদানীং বিজেপির মধ্যে খুব কমই দেখা যাচ্ছে। সকলেই নিজের মতো করে খেলতে চাইছেন। রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন ও তার পর লোকসভা নির্বাচনের আগে তাই দল বেঁধে চলার থিমকেই এই রাজ্যের জন্য বেছে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব।

Advertisement

একসঙ্গে চলার শিক্ষা চলল তিন দিন। — নিজস্ব চিত্র।

সেই বার্তাও দিয়ে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। রাজ্যের দায়িত্ব পাওয়া পর প্রথম বারের সফরে অবশ্য খুব বেশি ঝাঁজ ছিল না পর্যবেক্ষক সুনীলের বক্তব্যে। তবে উত্তরপ্রদেশের অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বার বার ‘ঐক্য’ থিমের আশপাশ দিয়েই হেঁটেছেন। সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) বি এল সন্তোষ মোট দু’বার বক্তৃতা করেছেন। একটি সাংসদ ও বিধায়কদের নিয়ে আলাদা করে। অন্যটি শিবির শেষের বক্তব্য। বিজেপির পরিভাষায় ‘দীক্ষান্ত ভাষণ’। বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, দুই বক্তব্যেই একটাই কথা সন্তোষ নানা ভাবে বলে গিয়েছেন যে, ঐক্য চাই। সকলে একসঙ্গে চলার নামই সংগঠন। সেটা মেনে না চলতে পারলে কেমন বিপদ হতে পারে সে বার্তাও দিয়েছেন তিনি। বিজেপির ইতিহাসের নানা উদাহরণ তুলে ধরে বলেছেন যে, দলীয় শৃঙ্খলা ভাঙার কত বড় সাজা হতে পারে। অতীতে অনেক প্রথম সারির নেতাই যে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে বহিষ্কারের মতো সাজা পেয়েছেন তার একাধিক উদাহরণ দেন তিনি। শিবির শেষে রাজ্যের এক সাংসদ বলেন, ‘‘কারও নাম সন্তোষজি বলেননি। কিন্তু তাঁর অসন্তোষ কাদের প্রতি তাঁরা ঠিকই বুঝে গিয়েছেন।’’

রাজ্যের নেতারাও নানা বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন। যেমন, সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপের বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কী ভাবে গরিবদের জন্য কাজ করছেন। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নেতাদের ভূমিকা বিষয়ে বক্তৃতা করেছেন। আর রাজ্য সভাপতি সুকান্ত বলেন, রাজ্য বিজেপির আগামীর পরিকল্পনা নিয়ে। তবে শিবিরে যোগ দেওয়া নেতাদের অনেকেরই দাবি, সবার নজর কেড়ে নিয়েছেন বালুরঘাটের বিধায়ক অশোক। তিনি রাজ্যের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে বলে সবার চেয়ে বেশি প্রশ্ন পেয়েছেন। একের পর এক প্রশ্নের উত্তরও নাকি তিনি দিয়ে গিয়েছেন নিরলস ভাবে। আবার প্রবীণ অর্থনীতিবিদ অশোক নিজেও যে খুব শিবির উপভোগ করেছেন তা-ও নাকি দেখা গিয়েছে। মাঝের দিনটায় জরুরি কাজে তাঁর কিছু ক্ষণের জন্য বাইরে যাওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু শেষ বেলায় তিনি শিবিরে ফুটবল খেলাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বেছে নেন।

রাজ্যে প্রথম কোনও কর্মসূচিতে যোগ নতুন পর্যবেক্ষক সুনীল বনসলের। — নিজস্ব চিত্র।

শুধু যে খেলা, বক্তৃতায় ঐক্যের বার্তা ছিল তা নয়। জানা গিয়েছে, থাকার ব্যবস্থাও এমন ভাবে করা হয়েছিল যাতে একের সঙ্গে আর একের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। যে নেতার সঙ্গে যে নেতার ঘনিষ্ঠতা থাকা দরকার হলেও সম্পর্কে টান নেই তাঁদের পাশাপাশি বিছানা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। একসঙ্গে ঘুম থেকে ওঠা, খেতে যাওয়া কিংবা আড্ডা দেওয়ার সুযোগটা করে দিয়ে অনেক ‘সাপ’ ও ‘নেউল’-এর মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা হয়েছে। সকলের সুর যাতে এক হয় তার চেষ্টাও ছিল। শিবিরে দু’টি গানের অভ্যাস করানো হয়েছে সকলকে। বাংলায় ‘সঙ্কোচেরই বিহ্বলতা নিজেরে অপমান...’ আর হিন্দিতে, ‘সংগঠন গড়ে চলো, সুপন্থ পর বড়ে চলো, ভালা হ্যায় যিসমে দেশকা, ওহ্ কাম সব কিয়ে চলো...’। শেষ দিনে সন্তোষ, বনসলদের সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে শোনাতেও হয়েছে দুই গান।

কেন্দ্রীয় নেতারা চলে গিয়েছেন দিল্লিতে। রাজ্যের নেতা, বিধায়ক, সাংসদরা নিজ নিজ কাজে। কিন্তু তিন দিনের প্রশিক্ষণ শিবিরে পাওয়া ঐক্যের মন্ত্র মাথায় থাকবে তো? রাজ্য সভাপতি সুকান্ত আনন্দবাজার অনলাইনের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাননি। শুধু বলেছেন, ‘‘সকলে খুব উপভোগ করেছেন। অনেকেই চেয়েছেন মাঝেমাঝেই এমন শিবির হোক। একসঙ্গে থাকার আনন্দ তো আজকাল কম হয়।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement