বৃহস্পতিবার বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ঘরে দিলীপ ঘোষ। — নিজস্ব চিত্র।
বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার ঘরে বৃহস্পতিবার দুপুরে যা হয়েছে, তাতে শুধু প্রদীপ-পায়েসের অভাব ছিল। এমনই মনে করছেন বিজেপির প্রবীণ নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, এর আগে দিলীপ ঘোষ তো নয়ই, অন্য কোনও বিজেপি নেতার জন্মদিন পালন হয়েছে বলে জানা নেই। শুধু বিধানসভাতেই নয়, দলের দফতরেও কোনও রাজ্যনেতার জন্মদিন ঘিরে এমন আচমকা আয়োজনের নজির নেই। ৪৪ বছরের পুরনো দলে এ এক নতুন উদ্যোগ। আর সেটা হল ঠিক তখনই, যখন ‘অভিমানী’ প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি বিজেপিতে তো বটেই, আদৌ রাজনীতিতে থাকবেন কি না, তা নিয়ে নিজেই বিভিন্ন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন।
দিলীপের জন্মদিন পালনের পর দলে শুরু হয়ে গিয়েছে নানা জল্পনা। দিলীপ-অনুগামীরা বলতে শুরু করেছেন, দিলীপকে ছাড়া বাংলায় পদ্মের রাজনীতি যে সম্ভব নয়, সেই বার্তাই বৃহস্পতিবার দিয়ে দিয়েছেন দলের পরিষদীয় নেতা থেকে বর্তমান রাজ্য নেতৃত্ব। পাশাপাশিই পদাধিকারীরা দলের মধ্যে ‘আদি’ ও ‘নব্য’ গোষ্ঠীর লড়াইও থামাতে চাইছেন। যদিও দলের রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলছেন, ‘‘বিষয়টা তেমন নয়।’’ বৃহস্পতিবারের ঘটনাপ্রবাহের সময়ে তিনি ছিলেন দিল্লিতে। শুক্রবার বালুরঘাটে ফেরার পরে সুকান্ত বলেন, ‘‘বিজেপির মধ্যে যে আদি ও নব্য বিভাজনের কথা বলা হয়, সেটা পুরোপুরি সংবাদমাধ্যমের তৈরি। আমি প্রায় তিন বছর সভাপতি থাকলেও এমন কোনও বিভাজন বুঝতে পারিনি। বিচ্ছিন্ন কিছু কথাবার্তা নিয়ে এমন ভাগাভাগি করা অর্থহীন। গোটা দেশের মতো বাংলাতেও বিজেপি একটিই।’’
দিলীপ সম্পর্কেও সুকান্তের বার্তা স্পষ্ট। তাঁর কথায়, ‘‘যিনি যে পদেই থাকুন, আমরা সকলে দিলীপদাকে আমাদের নেতা বলেই মনে করি। তাঁর ৬০ বছরের জন্মদিন পালনের ইচ্ছা তো হতেই পারে। তা নিয়ে নতুন কিছু ভাবার কোনও কারণ নেই। শ্রদ্ধা-ভালবাসা জানানোর মধ্যেও রাজনীতি দেখাটা এক রকমের অসুখ।’’
সুকান্ত এমন বললেও বিজেপি সূত্রের খবর, তাতে আগামী দিনে এমন অনেক নতুন ছবি দেখা যাবে। দিলীপকে ‘মধ্যমণি’ করে সুকান্ত-শুভেন্দুদের নতুন কর্মসূচি দেখারও সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, রাজ্য বিজেপিতে গোষ্ঠীবিবাদ থাকলেও একটা বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত— লোকসভা ভোটের পরে এই সঙ্কটসময়ে দিলীপকে নিয়ে বাকি দুই নেতা পথে নামলে জমবে আন্দোলন। মজবুত হবে সংগঠনও। ফুল এবং মিষ্টির পরে সেটিই হল আসল ‘মোর’। আরও কিছু।
এমনিতে নিজের জন্মদিন পালন নিয়ে কখনও খুব আগ্রহ ছিল না দিলীপের। তাঁর নিজের পরিবারেও সেই রেওয়াজ ছিল না। দিলীপের মা পুষ্পলতা ঘোষ অবশ্য মেজো পুত্র নাড়ুর (দিলীপের ডাকনাম) জন্মদিন পালন করেন বাংলা মতে ৫ বৈশাখ। দিলীপ ‘নেতা’ হওয়ার পরে ১৮ বা ১৯ এপ্রিল (যে বছর যেমন হয়) কুলিয়ান গ্রামে গেলে পরমান্ন রেঁধেছেন মা। আবার সরকারি নথি অনুযায়ী ১ অগস্টের জন্মদিনে নিয়মিত বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের শুভেচ্ছাবার্তা পেতেন রাজ্য সভাপতি দিলীপ। সাংসদ থাকার সময়ে ওই দিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শুভেচ্ছাচিঠিও পেয়েছেন। সমাজমাধ্যমে তা পোস্ট করতেন দিলীপ। ঘনিষ্ঠেরা জানিয়েছেন, এ বারেও কেন্দ্রীয় নেতারা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তবে মোদীর চিঠি পোস্ট করেননি দিলীপ। ঘনিষ্ঠরা বলছেন, সম্ভবত ওই চিঠি এ বার আসেনি।
তবে এসেছিল একটি আপাতদৃষ্টিতে ‘অনভিপ্রেত’ ফোন। বিধানসভায় দিলীপের জন্মদিন পালনের ইচ্ছা জানিয়ে তাঁকে ফোন করেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। রাজ্য বিজেপিতে দিলীপের সঙ্গে যাঁর সব চেয়ে বেশি ‘দূরত্ব’। বৃহস্পতিবারই সে কথা বিধানসভা চত্বরে জানিয়েছেন দিলীপ। সেই ডাকে তিনি সাড়া দেওয়ায় মিষ্টিমুখ থেকে লাল গোলাপে পালিত হয়েছে ৬০ বছরের জন্মদিন। বিধানসভা থেকে বার হতেই এক রাজ্য নেতার ফোন পান দিলীপ। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক দিন পর দিলীপ কোনও বৈঠক ছাড়াই হাজির হন সল্টলেকে বিজেপির নতুন পার্টি অফিসে। সেখানে কেকের মতো দেখতে সন্দেশ এনে কাটা হয়। হইহই করে জন্মদিন পালনে হাজির ছিলেন বাংলার দুই সাধারণ সম্পাদক, দুই প্রবীণ নেতা ছাড়াও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) সতীশ ঢন্ড।
বৃহস্পতিবারের জন্মদিন পালনের উদ্যোগের পিছনে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেরও কি কোনও বার্তা রয়েছে? এমন প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে পদ্মশিবিরে। অনেকের দাবি, দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে সঙ্ঘ পরিবারের শীর্ষকর্তারা দিলীপকে সঙ্গে নিয়ে চলারই বার্তা দিয়েছেন রাজ্য নেতাদের। দলের আসন্ন সাংগঠনিক রদবদলে দিলীপ ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকায় চলে আসতে পারেন বলেও জল্পনা। ঘোষ-ঘনিষ্ঠদের দাবি, সেই ‘ইঙ্গিত’ পেয়েই রাজ্য নেতৃত্ব পর পর কর্মসূচিতে দিলীপকে ডাকছেন। তবে দিলীপ নিজে নীরব। অনুগামীদের বক্তব্য, তিনি চুপ, কারণ, পাছে মুখ খুললে বিতর্ক তৈরি হয়ে ‘অনুকূল’ পরিস্থিতি বিগড়ে যায়!