সল্টলেকের করুণাময়ীতে। ছবি: শৌভিক দে।
এক সময়ে হোর্ডিং-এর ব্যবসায় নেমেছিলেন তৃণমূলের গ্রেফতার হওয়া কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। সেই সময়ে তিনি রাজনীতি করতেন না।
সূত্রের খবর, ২০১০ সালে তিনি কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া পর্যন্ত অনিন্দ্যের কাছ থেকে সেই হোর্ডিং-এর ভাড়া বাবদ বিধাননগর পুরসভার পাওনা ছিল ৭ লক্ষ টাকা। কাউন্সিলর হওয়ার কয়েক মাস পরে কোনও এক ‘জাদুবলে’ সেই পাওনা মকুব হয়ে যায় তাঁর। এখন তদন্তে নেমে বিধাননগর পুর কর্তৃপক্ষের হাতে এমন সব তথ্যই উঠে এসেছে।
তদন্তে উঠে এসেছে, শুধু অনিন্দ্য নয়, এই হোর্ডিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আরও সব কাউন্সিলরের নামও। ২০১০ সালে বিধাননগর পুরসভার ক্ষমতা দখল করে তৃণমূল। তার এক বছর পর থেকে এটা প্রায় অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, বিধাননগরের প্রত্যেক কাউন্সিলর কোটা হিসেবে দু’টি করে হোর্ডিং পাবেন। সেই হোর্ডিং সব সময়ে যে কাউন্সিলরের নিজের এলাকাতেই হতে হবে, এমনও নয়। বিধাননগরের ভিতরের দিকের কাউন্সিলর ইএম বাইপাস লাগোয়া হোর্ডিং-ও পেয়েছেন। জানা গিয়েছে, তাঁর বকেয়া টাকা মকুব হয়ে যাওয়ার পরে কোটার সেই দু’টি হোর্ডিং অনিন্দ্যও পেয়েছিলেন। সেই সময়ে ২৫ জন কাউন্সিলর ছিলেন বিধাননগর পুরসভায়। জানা গিয়েছে, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগ কাউন্সিলরই হোর্ডিং কাজে লাগিয়েছেন।
সেই সময়ে বলা হয়েছিল, প্রত্যেক কাউন্সিলরের এলাকায় বেকার যুবকেরা যাতে হোর্ডিং ভাড়া দিয়ে কিছু রোজগার করতে পারেন, তার জন্যই দু’টি করে হোর্ডিং দেওয়া হয়েছিল কাউন্সিলরদের। কিছু কাউন্সিলর সেই মতো কিছু বেকারকে সাহায্যও করেছিলেন। যদিও তদন্তে উঠে এসেছে, বেশির ভাগ কাউন্সিলরই কোটার সেই হোর্ডিং তুলে দিয়েছিলেন পছন্দের ব্যবসায়ীর হাতে। অভিযোগ, যার বদলে মাসে মাসে সেই ব্যবসায়ী ‘খুশি’ করে দিতেন কাউন্সিলরকে। হোর্ডিং-এর ভাড়া বাবদ ওই সব ব্যবসায়ীরই পুরসভাকে বছরে ৪১ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল। পুর কর্তৃপক্ষ জানতে পেরেছে, কাউন্সিলরকে নিয়মিত ‘খুশি’ রাখলেও অনেক ব্যবসায়ীই দীর্ঘ দিন ধরে পুরসভাকে সেই ভাড়া দেননি। অথচ বছরের পর বছর সেই হোর্ডিং-এর মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুরসভা থেকে। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, এ ভাবে কোটি টাকারও বেশি বকেয়া পড়ে রয়েছে। যার মধ্যে অনিন্দ্যর ৭ লক্ষ টাকাও রয়েছে।
এ তো গেল আইনি হোর্ডিং-এর কথা। তদন্তে উঠে এসেছে বেআইনি হোর্ডিং-এর গল্পও।
জানা গিয়েছে, ২০১০ সালে ক্ষমতায় আসার পরেই দেখা যায়, বিধাননগর জুড়ে এমন অনেক হোর্ডিং জ্বলজ্বল করছে, যার কোনও নথি পুরসভার কাছে নেই। কারও কোনও অনুমতি না নিয়েও সেই হোর্ডিং রমরম করে চলছিল। তার তালিকা তৈরি করে সেই সময়ে অভিযানে নেমেছিল পুরসভা। শুরু হয়েছিল সেগুলি কেটে ফেলার কাজ। পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, সেই সময়েই নগর জুড়ে প্রায় ১৫০টি বেআইনি হোর্ডিং-এর হদিস পাওয়া গিয়েছিল। লোহার কাঠামো তৈরি করে সেই সব ২০ ফুট বাই ১০ ফুটের বড় বড় হোর্ডিং-এর ২০ শতাংশ কেটে ফেলা হয়েছিল। সেই লোহা বিক্রি করে কয়েক লক্ষ টাকা এসেছিল পুরসভার ঘরে। ২০১১ সালের পরে অজ্ঞাত কারণে সেই অভিযান বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৫ সালে জিতে আসার পরে বেআইনি হোর্ডিং নিয়ে নতুন করে আবার অভিযানে নেমেছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচী দত্ত জানিয়েছেন, নতুন করে অভিযান চালিয়ে বিধাননগর এলাকায় ২১০টি এমন হোর্ডিং পাওয়া গিয়েছে, যার নথি পুরসভায় রয়েছে। আর বেআইনি হোর্ডিং রয়েছে ১৫২টি। সব্যসাচী বলেন, ‘‘আমরা রাস্তায় নেমে এই সব বেআইনি হোর্ডিং-এর ভিডিওগ্রাফিও করে রাখছি। এই হোর্ডিংগুলি আইনি করে দিলে প্রতি বছর আমাদের অতিরিক্ত ১ কোটি ২১ লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা।’’ যেহেতু আইনি হোর্ডিং-এরও বহু টাকা ভাড়া বকেয়া পড়ে রয়েছে তাই মেয়র জানান, ২০১৬ সালের মার্চের পর আর কোনও হোর্ডিং-এর মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। সমস্ত বকেয়া টাকা চাওয়া হয়েছে।
যে সময়ে হোর্ডিং নিয়ে এই বেনিয়ম, দীর্ঘদিন ধরে হোর্ডিং-এর ভাড়া জমা পড়েনি পুরসভায়, অনিন্দ্যর ৭ লক্ষ টাকা মকুব করা হয়েছিল, সেই সময়ে পুরসভার চেয়ারপার্সন ছিলেন তৃণমূল নেত্রী কৃষ্ণা চক্রবর্তী। তাঁকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন ২১ জুলাই-এর অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। সেই অনুষ্ঠান মিটে গেলে কথা বলব।’’