অনুষ্ঠানে সিপি মুকেশ (বাঁ দিকে) ও ডিসি সূর্যপ্রতাপ যাদব। ছবি: রণজিৎ নন্দী
ওঁরা কিছুটা অন্য রকম হতে পারেন। তবে আলাদা নন। এ কথা বলেই যৌন সংখ্যালঘু তথা সমকামী-রূপান্তরকামীদের প্রতি বৈষম্য বা দুর্ব্যবহার বন্ধ করতে কড়া বার্তা দিলেন বিধাননগরের সিপি মুকেশ। সোমবার ‘রেনবো কেয়ার’ শীর্ষক একটি সচেতনতা শিবিরে তিনি স্পষ্ট বলেন, ‘‘এলজিবিটিকিউ মানুষদের অধিকার নিয়ে পুলিশের উপরতলা তা-ও সচেতন। কিন্তু থানার ডিউটি অফিসার থেকে রক্ষীদের স্তরে সচেতনতার খুবই অভাব। এটা শুধরোতে হবে।’’
সমকামী-রূপান্তরকামীদের অধিকার রক্ষায় সক্রিয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই অনুষ্ঠানে কয়েক জন প্রবীণ আধিকারিক অবশ্য তাঁদের সংশয়ের কথাও বলেছেন। যেমন, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার পর্যায়ের এক জন অফিসার রূপান্তরকামী, সমকামীদের উদ্দেশ্যে বলতে যান, ‘‘আপনাদের মধ্যে কেউ অপরাধ করলে কিন্তু আপনাদেরই পুলিশকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে হবে।’’ তাঁকে কার্যত থামিয়ে মুকেশ বলেন, ‘‘অপরাধ কেউ করলে লিঙ্গপরিচয় দেখার কথা নয়। তিনি নিজেকে ছেলে বা মেয়ে— কী ভাবেন, অথবা কার কী যৌন পছন্দ, তার সঙ্গে অপরাধের সম্পর্ক নেই। অপরাধের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে অন্যের উপরে নির্ভর করবেন না।’’ সমাজের এই ‘বিশেষ’ মানুষদের সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে পুলিশের যে খামতি রয়েছে, তা স্বীকার করেই সহকর্মীদের এগোতে বলেন সিপি।
মাসখানেক আগে নিউ টাউনে তথাকথিত ‘মেয়েলি’, বিধাননগর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্সের পড়ুয়া এক তরুণকে চোর সন্দেহে হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল। তার পরেই পুলিশকর্মীদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর দরকার রয়েছে বলে বোঝেন সংশ্লিষ্ট ডিসি কামনাশিস সেন। এ দিন রঙিন জামায় সেজে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ওই তরুণও।
রূপান্তরকামী বা সমকামীদের সুরক্ষায় দেশে বা রাজ্যে কিছু নতুন আইনের বিষয়েও ততটা ওয়াকিবহাল নয় পুলিশ। সমাজকর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘রাজ্যে গণপিটুনি রোখার আইনে লিঙ্গ বা যৌন পছন্দের জন্য হামলা হলে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার সুরক্ষা আইনেও রূপান্তরকামীদের হেনস্থা প্রমাণ হলে দোষীর জেল হতে পারে।’’ এই ধরনের মামলার তদন্তের খুঁটিনাটি নিয়ে বিধাননগরের থানার ওসিদের প্রশ্নের জবাব দেন হাইকোর্টের আইনজীবী সুমন গঙ্গোপাধ্যায়।
রূপান্তরকামীদের লড়াইয়ের পরিচিত মুখ রঞ্জিতা সিংহ নিজে কলকাতার একটি পুলিশ পরিবারে জন্মেছেন। তিনি সতর্ক করেন, রূপান্তরকামী বা ‘মেয়েলি’ ছেলেদের ধরলে কটূক্তি বা তুইতোকারি করার প্রবণতা বন্ধ হওয়া উচিত।
কয়েকটি তথ্যচিত্রে এ দেশে সমকামী-রূপান্তরকামীদের আইনি লড়াইয়ের ইতিহাস এবং সংবিধান অনুযায়ী অধিকারের দিকগুলিও পুলিশের সামনে মেলে ধরা হয়। ২০১৪-র নালসা রায়ে তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি এবং ২০১৭-য় যৌন সংখ্যালঘু বা এলজিবিটিদের প্রতি বৈষম্যমূলক ৩৭৭ ধারা দূরে হটানো আদতে সব নাগরিকের সমানাধিকারকেই প্রতিষ্ঠা করছে বলে এ দিন পুলিশকে বোঝানো হয়। পরিবার বা কাজের জায়গায় পীড়নের দিকগুলিও তুলে ধরা হয়। বিধাননগরের ডিসি (সদর) সূর্যপ্রতাপ যাদবও উদ্যোগটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিছু দিন অন্তর এই ধরনের শিবির আয়োজনেও আগ্রহী পুলিশ। যৌন সংখ্যালঘু অধিকার রক্ষা কর্মীদের মতে, এর আগে পুলিশের তরফে এই বিষয়গুলি নিয়ে এতটা সক্রিয় সচেতনতার উদ্যোগ সে ভাবে দেখা যায়নি। অনুষ্ঠানে পুলিশকর্তাদের সহৃদয়তাও বদলের স্মারক বলে তাঁরা মনে করছেন।