প্রতীকী ছবি।
সন্ধির বার্তার সূচনা হয়েছিল ভবানীপুর থেকে। ভবানীপুরের সেই উপনির্বাচন মেটার আগেই সন্ধির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়ে গেল! কারণ, শুধু কংগ্রেসকে আক্রমণই নয়, নিজেদেরকেই ‘আসল কংগ্রেস’ বলে ফের দাবি করতে শুরু করে দিল তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের মতে, তৃণমূল এখন ‘মহাসমুদ্র’ এবং কংগ্রেসের প্রতি তাদের কটাক্ষ, ‘পচাডোবা আজ অপ্রাসঙ্গিক’। এই প্রেক্ষিতে কংগ্রেসও কৌশল বদলে স্থির করল, এমন আক্রমণ হলে পরিস্থিতির প্রয়োজনে তারাও পাল্টা জবাব দেবে। তৃণমূলের কাছে মূল শত্রু নরেন্দ্র মোদী না রাহুল গাঁধী, সেই প্রশ্নও ফের সামনে এল।
বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৃহত্তর জোটের অঙ্ক কষে ভবানীপুরে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপরীতে প্রার্থী দেয়নি কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। ভবানীপুরের প্রচার থেকেও সরে দাঁড়িয়েছে কংগ্রেস। কিন্তু এরই মধ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং তাঁর ভাইপো, তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ধারাবাহিক ভাবে সেই আক্রমণে শামিল। এমতাবস্থায় বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে শান্তি-সমঝোতার ভবিষ্যৎ নিয়ে ফের ভাবনা-চিন্তা করতে হচ্ছে কংগ্রেসকে। আপাতত তৃণমূলের আক্রমণের যাতে কড়া ও সমুচিত প্রত্যুত্তর দেওয়া যায়, সেই সবুজ সঙ্কেত প্রদেশ কংগ্রেসের কাছে এসে পৌঁছেছে এআইসিসি-র তরফে। এবং তার পরেই ফের ‘সক্রিয়’ হয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী।
বস্তুত, শুধু কংগ্রেসকে আক্রমণই নয়, নিজেদেরকেই এখন গোটা দেশের নিরিখে ‘আসল কংগ্রেস’ বলে দাবি করতে শুরু করেছে তৃণমূল। শাসক দলের দৈনিক মুখপত্রে সম্পাদকীয়ের ভাষায়, ‘এটাই (তৃণমূল) মহাসমুদ্র। পচাডোবা আজ অপ্রাসঙ্গিক’। সেখানে আরও বলা হয়েছে, কংগ্রেসের ঐতিহ্যের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে তারাই যদি আসল কংগ্রেস হয়ে উঠতে পারে, তা হলে সারা দেশে কংগ্রেসের যা ভূমিকা ছিল, তারাই তা পালন করবে। এর মধ্যে কোনও ‘ইগো’ নেই, এটাই বাস্তব বলে তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি।
কংগ্রেসের ইতিহাস ধুয়ে জল খাওয়ার দিন শেষ বলে মুখপত্রে মন্তব্য করার পাশাপাশি এ দিনই শেক্সপীয়র সরণি এলাকায় উপনির্বাচনের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ফের বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস বিজেপিকে ভয় পায়! তাই কখনও কখনও সমঝোতায় আসে। মমতা কাউকে ভয় পায় না! তাই তৃণমূলকে ম্যানেজ করতে পারেনি বিজেপি।’’
পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীরবাবুর বক্তব্য, ‘‘ওঁরা মোদীর বিরুদ্ধে লড়ছেন, না রাহুল গাঁধীদের সঙ্গে লড়াই করছেন, সেটাই ঠিক নেই! কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বললে বিজেপি যে সব চেয়ে খুশি হবে, এতে কোনও সংশয় নেই।’’ একই সুরে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীও বলছেন, ‘‘মুখে বিজেপি-বিরোধী ঐক্যের কথা বলে কার্যক্ষে্ত্রে বিরোধী ঐক্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে তৃণমূল। তাদের কাছে মূল শত্রু বিজেপি না কংগ্রেস? তাদের এই ভূমিকায় লাভ হচ্ছে বিজেপির।’’
রাজ্যে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা সরকারের প্রধানের বিরুদ্ধে উপনির্বাচনে প্রার্থী দেওয়ার দরকার নেই, এই প্রস্তাবের প্রথম উত্থাপক ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিই। দলীয় বৈঠকে রাজ্যের নেতাদের বড় অংশ অবশ্য প্রার্থী দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। যদিও এআইসিসি শেষমেশ প্রার্থী না দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেয়। জাতীয় স্তরে যখন বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির সমন্বয় বাড়ছে, সে সময়ে বাংলায় এই সিদ্ধান্তকে বৃহত্তর জোটের ইঙ্গিতবাহী বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু তার পরেও তৃণমূল উল্টে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করায় সমীকরণ আবার তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। প্রদেশ কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘‘রাহুল গাঁধী এখন তৃণমূল নেতৃত্বের আক্রমণের জবাব দিতে যাবেন না। আঞ্চলিক দলগুলির বিপক্ষে বলা তাঁর এখন লক্ষ্যও নয়। কিন্তু সৌজন্য বা বার্তা, কোনওটাই এক তরফা হয় না। তাই আপাতত দিল্লি থেকে প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বকেই বলা হয়েছে পরিস্থিতি বুঝে আক্রমণের জবাব দিতে।’’
হাইকম্যান্ডের নির্দেশে ভবানীপুর ছেড়ে দিতে হলেও বাংলায় কংগ্রেসের অবস্থা যথেষ্টই সসেমিরা! বামেদের সঙ্গে জোট ভাঙার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত না নিয়েই ভবানীপুরের ওই পদক্ষেপ হয়েছে। আবার যে তৃণমূলের প্রতি ‘সৌজন্য’ দেখিয়ে ভবানীপুরে প্রার্থী দেওয়া হয়নি, তাদের দিক থেকে ক্রমাগত কংগ্রেসের সমালোচনা আসছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলায় কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা ভুগছেন দিশাহীনতায়। দলের ‘লাইন’ ঠিক করার দাবি উঠছে কংগ্রেসের অন্দরে। তৃণমূলের আক্রমণের পরে ‘নরম’ অবস্থান ছেড়ে পাল্টা জবাব দিলে অন্তত পরিস্থিতি খানিকটা হাল্কা হবে বলেই কংগ্রেস নেতৃত্বের আশা।
অধীরবাবুর কথায়, ‘‘দেশের ১৯টা বিরোধী দল মিলে বিজেপির বিরুদ্ধে যৌথ কর্মসূচি নিল, যেটা ২০ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হল। আর সেই সময়ে তৃণমূলের টানা বিষোদগার শুরু হল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। ইডি-র দফতরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জেরা করার পর থেকেই কংগ্রেসকে খারাপ লাগতে শুরু করার রহস্যই বা কী!’’