সেবিছে ঈশ্বর: পথকুকুরদের খাওয়াচ্ছেন সাঁতরাগাছি ট্র্যাফিক গার্ডের আধিকারিকেরা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
জরুরি কাজে বেরিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-পড়ুয়া সাহানা সিংহ চাঁদনি চকের অফিসপাড়ায় দেখেন, একটি পাখির দিকে প্রবল আক্রোশে তেড়ে যাচ্ছে একটি কুকুর। সেটিকে ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় কুকুরটির নিশানা হয় ইঁদুর। সেটিও ধরতে না পেরে গর্জাতে গর্জাতে টায়ার চিবোতে শুরু করে সে।
কুকুরটির কি তবে প্রবল খিদে পেয়েছে? এই প্রশ্নের সঙ্গেই সাহানার মাথায় আসে আরও একটি প্রশ্ন। বহু বছর ধরে মানুষের সান্নিধ্যে থেকে যে প্রাণী শিকার করতে কার্যত ভুলেই গিয়েছে, তার হঠাৎ এমন ক্ষিপ্রতা কেন? তবে কি লকডাউনের জেরে মানুষের সান্নিধ্য কমতে থাকায় হিংস্র হয়ে উঠছে কুকুর, বেড়ালেরা?
এমন প্রশ্ন নিয়েই গত বছরের লকডাউনের সময়ে গবেষণা চালিয়েছিলেন আইআইএসইআর-এর বায়োলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের গবেষকেরা। সেখানকার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর অনিন্দিতা ভদ্র বলেন, “সাধারণ মানুষের থেকে নমুনা নিয়ে লাগাতার পরীক্ষার পরে দেখা গিয়েছে, লকডাউনে কুকুর-বেড়ালেরা এলাকাছাড়া হয়েছে। তাদের স্বভাব বদলাতে দেখা গিয়েছে খাদ্যাভাবের কারণে। মানুষের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াও প্রভাব ফেলেছে।” সেই সঙ্গে তাঁদের দাবি, বাজার বা জনবসতি এলাকায় কুকুর, বেড়ালদের খাবার পেতে সে ভাবে সমস্যা হয় না। অফিসপাড়ায় এই সমস্যা বেশি হওয়ায় সেখানকার কুকুর, বেড়ালদের স্বভাবে বদলও ঘটেছে বেশি মাত্রায়। তাই তাদের নিয়মিত খাওয়ানোর ব্যাপারটা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে তাঁদের দাবি।
সেই কাজই করছেন হাওড়া সিটি পুলিশের কোনা ট্র্যাফিক গার্ডের অফিসার-কর্মীরা। এখন হোটেল, দোকানপাট সবই বন্ধ। লোকজনও রাস্তায় বেরোচ্ছেন কম। ফেলে দেওয়া খাবার মেলাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। প্রায় অভুক্ত পথকুকুরদের বাঁচাতে তাই নিজেদের টাকায় দু’বেলা খাবার দিচ্ছেন ওই পুলিশকর্মীরা। প্রথমে তাঁরা বিস্কুট কিনে দিচ্ছিলেন, তবে ২০-৩০টি কুকুরের মধ্যে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাচ্ছিল। ট্র্যাফিক গার্ডের এক পদস্থ অফিসার বলেন, ‘‘ওরা খাবারের আশায় অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকত। আমাদের মনে হয়েছিল ওদেরও বাঁচানো দরকার। তাই প্রতিদিন দু’বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছি।’’ কোনও দিন রান্না হয় খিচুড়ি, কোনও দিন ভাত, তরকারি। দুপুর ১২টা ও রাতের দিকে আলাদা আলাদা কলাপাতার থালায় খেতে দেওয়া হয়। হাওড়া ট্র্যাফিক পুলিশের ডিসি অর্ণব বিশ্বাস বলেন, ‘‘শুধু পথকুকুরদের খাওয়ানো নয়, কড়াকড়ির প্রথম দিকে দূরপাল্লার ট্রেন থেকে সাঁতরাগাছিতে নামা যাত্রীদের খাবার থেকে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা, সবই করেছেন ওই ট্র্যাফিক গার্ডের কর্মীরা। এক এক দিন ১২০০ লোকও খেয়েছেন। নিজেরা চাঁদা তুলে এই প্রশংসনীয় কাজ ওঁরা করছেন।’’
কলকাতা পুলিশের গরফা, যাদবপুর, কসবা, মানিকতলা, শ্যামপুকুর, বড়তলা থানার পুলিশ কর্মীরাও দু’বেলা রান্নার ব্যবস্থা করেছেন। শহরের নানা রাস্তায় কুকুরদের খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করছেন তাঁরা। এক পুলিশকর্মী বলেন, “কোনও থানাই এলাকা ধরে ভাবছে না। মূলত অফিসপাড়াতেই দেওয়া হচ্ছে খাবার। তার পরে নানা এলাকায় ঘুরে ঘুরে দেওয়া হচ্ছে।”
এর পরেও কি ওই প্রাণীদের স্বভাবে বদল চোখে পড়তে পারে? গবেষকদের বক্তব্য, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কুকুর-বেড়ালেরা কতটা সহজে ফের মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারবে, তার উপরেই নির্ভর করছে অনেক কিছু। ইতিমধ্যে ওদের খাবারের জোগান বজায় রাখতে হবে।