আয়ার মারে রক্তাক্ত বৃদ্ধা, তবু ‘অসহায়’ হাসপাতাল

সুস্থ হয়ে ওঠার আশায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন রেণু সরকার। ৮৫ বছরের ওই বৃদ্ধা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি, সেই নামী সরকারি মেডিক্যাল কলেজেই নগদ টাকা দিয়ে রাখা আয়ার কাছে বেধড়ক মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে বন্ড দিয়ে হাসপাতাল ছাড়তে হবে তাঁকে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৬ ০১:০১
Share:

রেণু সরকার

সুস্থ হয়ে ওঠার আশায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন রেণু সরকার। ৮৫ বছরের ওই বৃদ্ধা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি, সেই নামী সরকারি মেডিক্যাল কলেজেই নগদ টাকা দিয়ে রাখা আয়ার কাছে বেধড়ক মার খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে বন্ড দিয়ে হাসপাতাল ছাড়তে হবে তাঁকে।

Advertisement

গত মঙ্গলবার রাতে কলকাতার আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফিমেল মেডিসিন বিভাগের ২৪ নম্বর শয্যায় ভর্তি রেণুদেবীকে দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন লিলি নামের এক আয়া। রেণুদেবীকে সেই সময়ে রক্ত দিতে হচ্ছিল। যন্ত্রণায় বৃদ্ধা শয্যায় শুয়ে ছটফট করছিলেন। এতে তাঁর হাতে করা চ্যানেল একটু সরে যায়। অভিযোগ, তাতেই খেপে ওঠেন আয়া। রেণুদেবীর দু’টো হাত খাটের সঙ্গে বেঁধে মারতে শুরু করেন তাঁকে। চিৎকার করতে থাকেন বৃদ্ধা। আশপাশের রোগীরাও তা দেখে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত অন্য আয়ারা এসে কোনও মতে ওই আয়াকে থামান। ততক্ষণে রেণুদেবীর হাত আর ঘাড় কেটে পরনের কাপড় রক্তে ভেসে গিয়েছে।

আতঙ্কিত রেণুদেবী এই ঘটনার পরে আর হাসপাতালে থাকতে চাননি। ভয়ে তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ক্রমাগত কান্নাকাটি করছেন। বৃহস্পতিবার সকালেই বন্ড দিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান পরিজনেরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁরা ওই আয়ার নামে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পরে হাসপাতাল থেকেও টালা থানায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। অভিযুক্ত আয়া অবশ্য বুধবার রাত থেকেই গা ঢাকা দিয়েছেন।

Advertisement

এখন প্রশ্ন হল, আইনানুযায়ী লিলিদের তো সরকারি হাসপাতালে থাকারই কথা নয়। সেখানে আয়া নিষিদ্ধ। অথচ তাঁরা অর্থাৎ, আয়ারা আছেন বহাল তবিয়তে। স্বাস্থ্য দফতরও এ কথা বিলক্ষণ জানে। কিন্তু তাদের হাত-পা বাঁধা। কারণ খাতায়-কলমে ওই আয়ারা থাকেন রোগীদের বাড়ির লোক হিসেবে। দস্তুরমতো হাসপাতালের কাগজে সই করে তাঁদের নিজেদের বাড়ির লোকের সিলমোহর দেন রোগীর পরিবারের লোকেরাই। রোগীর সঙ্গে রাতে বাড়ির লোক হিসেবে থাকেন সেই আয়ারা। ফলে আইনানুযায়ী হাসপাতালেরও কিছু বলার থাকে না।

এ অনেকটা লাইসেন্সহীন অটোর মতো দশা। যদি সেই অটো কাউকে ধাক্কা মেরে বা চাপা দিয়ে পালায়, তা হলে পরবর্তীকালে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করাই দুষ্কর। আয়ার ক্ষেত্রেও সমস্যাটা অনেকটা তেমনই। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, ‘‘খাতায়-কলমে হাসপাতালে যাঁর অস্তিত্বই নেই তিনি দোষ করলে তাঁকে হাসপাতালের পক্ষে ধরে শাস্তি দেওয়াটাও কার্যত অসম্ভব। তা-ও অভিযোগ পেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত আয়ার হাসপাতালে ঢোকা বন্ধ করে দেন। স্থানীয় থানায় অভিযোগ করে অনেক সময়ে আয়াকে ধরিয়েও দেন। কিন্তু তাতে এই আয়াচক্র বন্ধ করা যাচ্ছে না।’’

আয়াদের দুর্ব্যবহার, অযত্ন, মার, রোগীকে ওষুধ খাওয়ানোয় গাফিলতি, কাপড় বদলে দেওয়ায় অনীহা, রোগীর থেকে টাকা নেওয়া— সব নিয়েই ভুরিভুরি অভিযোগ। দিন পনেরো আগে মেডিক্যাল কলেজে ভগিনী নিবেদিতা ওয়ার্ডে ভর্তি একাধিক রোগিণীর আত্মীয়েরা সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আয়াদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জানান। প্রসবের পরে যে সব মা ও শিশুর অবস্থার অবনতি হয়, তাদের রাখা হয় ওই ওয়ার্ডে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, এর পরে আচমকা পরিদর্শনে যান সুপার এবং দেখেন, বারণ সত্ত্বেও ওই ওয়ার্ডে আয়ারা সদ্যোজাতকে বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছেন, চিৎ করে শুয়ে রাখছেন, রোগীকে প্রয়োজন মতো শৌচাগার ব্যবহার করতে দিচ্ছেন না, দুর্ব্যবহার করছেন। তার পরেই ওই ওয়ার্ডে আয়াদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যদিও অন্যান্য ওয়ার্ডে যথারীতি রোগীর বাড়ির লোক সেজে এক জন আয়া টাকা নিয়ে সাত জন রোগীর দায়িত্বে থাকছেন।

স্বাস্থ্য কর্তাদের যুক্তি, আসলে বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতির জন্যই আয়াদের পুরোপুরি আটকানো যাচ্ছে না। এখন ছোট ছোট পরিবার, আত্মীয়দের মধ্যে যোগাযোগ কম। কেউ কারও জন্য কিছু করতে চান না। সবাই নিজের মতো ব্যস্ত। ফলে কেউ অসুস্থ হলে, তাঁর সঙ্গে হাসপাতালে থাকার লোক পাওয়া যায় না। এই কারণেই দিব্যি চলছে আয়াচক্র। এবং থেকে যাচ্ছে এমন ঝুঁকি, যা হয়েছে রেণুদেবীর ক্ষেত্রে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement