প্রতীকী ছবি
মাস চারেক আগে রেস্তরাঁ খোলার সময়েও আশার আলো দেখেছিলেন ওঁরা। চলতি মাসে যখন পানশালা খোলার ছাড়পত্র এল, তখনও ভেবেছিলেন তাঁদের পালা এল বুঝি!
দক্ষিণ কলকাতায় লেকের কাছে গানবাজনা হয় এমন একটি পানশালার গাইয়ে কৌস্তভ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবছিলেন, ব্যান্ডের ছেলেমেয়েদের এ বার ফ্লোরে ফেরার সুখবর দিতে পারবেন। হাওড়ার টুম্পা মুখোপাধ্যায়ও ভেবেছিলেন, এ বার বুঝি চাঁদনি চকের পানশালায় গান গাইতে ফিরতে পারবেন। তাতে মায়ের ওষুধের খরচ, ফ্ল্যাটের বকেয়াটুকু তো মেটানো যাবে! তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক টুইটে সিনেমা থেকে জলসার ফেরার সম্ভাবনা তৈরি হলেও পানশালার শিল্পীরা এখনও কার্যত ব্রাত্য। রেস্তরাঁ-হোটেল বা পানশালাগুলির সংগঠনের দুই কর্তা সুদেশ পোদ্দার বা তরুণ চট্টোপাধ্যায় আশাবাদী, অক্টোবরেই গান ফিরবে পানশালায়। তবে খাতায়-কলমে নিশ্চয়তা নেই। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) শুভঙ্কর সিংহ সরকার মঙ্গলবার বলেন, ‘‘এখনও নির্দেশ বেরোয়নি।’’ তবে পানশালাগুলির তরফে পুলিশের কাছে দরবার চলছে।
সল্টলেক সেক্টর ফাইভের একটি লাউঞ্জ বারের কর্ণধার বরীশ চৌধুরী বলেন, ‘‘ডিজে বা লাইভ পারফরম্যান্সে আবগারি দফতরের আপত্তি। গান হলে ব্যবসা একটু ভাল হত। আগের তুলনায় এখন সপ্তাহান্তে বড়জোর ৩৫ শতাংশ ব্যবসা হচ্ছে। অন্য দিনগুলিতে আরও কম।’’ সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে একটি পানশালার কর্তা অনির্বাণ সেনগুপ্ত বা পার্ক স্ট্রিটে গানবাজনার জন্য বিখ্যাত সাবেক রেস্তরাঁর কর্তা আনন্দ পুরীও তাকিয়ে রয়েছেন পুলিশি ছাড়পত্রের দিকে। তবে রেস্তরাঁ-পানশালার কর্তারা একমত— সুর-তাল ফিরলে বাড়বে ব্যবসা। এই পরিস্থিতিতে ব্যান্ডের বদলে ফ্লোরে দু’-এক জন শিল্পী নিয়েই ভিড় কমানোর পক্ষপাতী রেস্তরাঁ কর্তৃপক্ষেরা।
তবে ইতিমধ্যে পার্ক স্ট্রিটের একটি পাঁচতারা হোটেলে নাইট ক্লাব খুলেছে, লাউঞ্জ বারেও গান হচ্ছে। ওই হোটেলের এক মুখপাত্রের ব্যাখ্যা, ‘‘গান বাজলেও সর্বত্র নাচ হচ্ছে না। বড়জোর নিজের টেবিলের আশপাশে দাঁড়িয়ে কেউ কোমর দোলাতে পারেন। তাতে দূরত্ব-বিধি অমান্য করা হচ্ছে না।’’
সাবেক অফিসপাড়া থেকে সেক্টর ফাইভ, ইএম বাইপাস বা দক্ষিণ কলকাতার আলো-আঁধারি পানশালাগুলি যে কোনও রকম নিয়ম মেনে আসর বসাতে এখন মরিয়া। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের একটি সাবেক পানশালার শিল্পী ভাস্কর বিশ্বাস কোনও মতে গানের ক্লাস নিয়ে যৌথ পরিবারের ভরসায় রয়েছেন। আর এক শিল্পী মোনালিসা মুখোপাধ্যায়ও মায়ের ভরসায়। একমাত্র মেয়ের নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়াশোনা নিয়ে জেরবার। সাধারণ ভাবে পানশালার শিল্পীদের সবটাই অতিথির টিপসের টাকায় চলে। ২০২০ সালে মন্দার বাজারে সেই টিপসের বহর খানিক কমেছিল। মধ্য কলকাতার একটি পানশালার সঙ্গে যুক্ত গানবাজনার দলের ম্যানেজার অর্জুন সোমের কথায়, ‘‘টিপস তুলনায় মেয়েরা বেশি পান। তাঁদের তুলনায় ছেলেদের অবস্থা আরও খারাপ।’’ তবে সকলেরই অবস্থা সঙ্গিন। অনেকেই সোনার গয়না বন্ধক রেখে সংসার টানছেন, কেউ অন্য পেশায় রুটিরুজির খোঁজ করছেন। মোনালিসার কথায়, ‘‘আমাদের প্রধান গায়ক বাধ্য হয়ে স্যানিটাইজ়ার বিক্রি করছেন, এক কি-বোর্ড শিল্পী ঘিয়ের কারবার করছেন। পুজোর আগে গান শুরু করতে না-পারলে না কী পরিস্থিতি হবে, ভাবতেও পারছি না।’’
কোভিড আবহে জলসা ফিরলেও পানের অনুষঙ্গে গান কী দোষ করল, সেই উত্তর এখনও খুঁজছেন তাঁরা।