শারদোৎসব মানেই বাঙালির মনের উৎসব, নতুন সৃষ্টির উৎসব। আবহাওয়া যাই বলুক না কেন, আশ্বিন মানেই গতে বাঁধা জীবন থেকে মুক্তির আশায় দিন গোনা শুরু। আশপাশের অতি পরিচিত বিষয়বস্তুর মধ্যেই নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার অনন্য মাদকতা।
এই সৃষ্টির আনন্দে কেউ বিজ্ঞানের সঙ্গে মেলাতে চান আধ্যাত্মিকতা, কেউ হস্তশিল্পের উপকরণের মাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিতে চান। আবার, বহু এলাকায় অনেকে মিলে পুজো করে নিজেদের ভাবনা ভাগ করে নিতে চান সবার সঙ্গে। সাবেক পুজোয় অনেকে খুঁজে পান শান্তি।
দক্ষিণ কলকাতার বড়িশা নেতাজি সঙ্ঘ ৩৯তম বর্ষে তাঁদের মাতৃ আরাধনায় ফিরিয়ে আনছে গ্রামবাংলার মাটির টান। বাঁশ, বেত ও শোলার কাজে তৈরি হচ্ছে পুতুল, পটচিত্র, কুলো, মুখোশ। থাকছে তিন ধাপের খড়ের চালা। দরমা, চাটাই, ঝুড়ি-সহ বিবিধ উপকরণে সাজছে মণ্ডপ। মণ্ডপ প্রাঙ্গণ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে লাল মাটি। একতারা হাতে থাকবেন বাউল। পল্লিবধূ রূপে থাকবেন দুর্গা। মায়ের দশ হাতের মধ্যে আটটি হাতে কোনও অস্ত্র থাকবে না। অন্য দু’টি হাতে থাকবে ত্রিশূল ও শঙ্খ।
দক্ষিণেরই আর এক পুজো পদ্মপুকুর বারোয়ারি সমিতি মূলধন করছে বাঙালির পুজোর সাবেকিয়ানাকে। তৈরি হচ্ছে দোতলা রাজবাড়ি। থাকছে ঠাকুরদালানও। সেখানে একচালায় দুর্গার সংসার। থাকছে বিশাল ঝাড়লন্ঠন। একান্নবর্তী পরিবারের পুজোর আনন্দ দর্শকেরা উপভোগ করতে পারবেন এখানে। ঠিক একই রকম উত্তর কলকাতার পাইকপাড়া সঙ্কল্পের পুজো। বিভিন্ন এলাকার মানুষদের নিয়ে তাঁদের এই আনন্দ উৎসব। কোনও চাঁদা না তুলে বেশ কয়েকটি পরিবার মিলে আয়োজন করে এই পুজোর। আনা হয় কৃষ্ণনগরের প্রতিমা। পাড়ার সবার সঙ্গে আনন্দ করে ওঁরা কাটান পুজোর ক’টা দিন।
প্রচলিত ধারণা ভেঙে আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনার মেলবন্ধন ঘটাতে চাইছে কসবা শক্তি সঙ্ঘ। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আজ, বুধবার ভারতের মঙ্গলযান পিএসএলভি ডি-৫ মঙ্গলে পৌঁছনোর কথা। এ ছাড়া, ২০২৩ সালে নেদারল্যান্ডসের একটি পাইলট প্রোজেক্টের মাধ্যমে সারা বিশ্ব থেকে ২০ জন অভিযাত্রী মঙ্গলে পৌঁছবেন। সেখানে ভারতের তিন জন প্রতিনিধির মধ্যে এক জন বাঙালি। এই দু’টি বিষয়কেই পুজোর মাধ্যমে তুলে ধরবেন তাঁরা। মঙ্গলযানের আদলে হচ্ছে মূল গেট। গেট পেরোলেই মঙ্গলগ্রহের আশ্চর্য দুনিয়া। মণ্ডপ চত্বর ঢাকা হচ্ছে লাল সুরকি দিয়ে। লোহার ফ্রেমে প্রতিমাকে শূন্যে ঝোলানো হবে। থাকবে মহাকাশচারী ও ক্যামেরার মডেলও। মণ্ডপের ছাদ যেন মহাকাশ। আলোর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হবে মঙ্গলগ্রহের পরিবেশ।
নিউ আলিপুর সর্বজনীনের এ বারের থিম প্রাচীন হিন্দু ধ্রুপদী নৃত্য। মণ্ডপের চারপাশে থাকছে চার বেদের কথা। মণ্ডপের অন্দরসজ্জায় ৯টি বড় এবং ২৫টি ছোট নৃত্যরত নারীমূর্তি। মূল গর্ভগৃহে মা দুর্গাকে দেখতে হবে ঘূর্ণায়মান মঞ্চে উঠে।
অন্য দিকে, হস্তশিল্পের উপকরণের মাধ্যমে নিজেদের পুজোকে অন্য মাত্রায় বাঁধতে চাইছেন গড়িয়ার রায়পুর ক্লাব সর্বজনীন। ২০ কুইন্টাল লোহার তার দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। মণ্ডপের চূড়ার গম্বুজটিও তৈরি হচ্ছে লোহার তার দিয়ে। দেবীপ্রতিমা সাবেক হলেও তাঁর সজ্জায় ধাতব গয়না। মণ্ডপের ভিতরে থাকছে রামায়ণ-মহাভারতের খণ্ডচিত্র।
উল্টোডাঙার জওহরলাল দত্ত লেনের পল্লীশ্রী সর্বজনীন নিজেদের পাড়াকেই দর্শকদের সামনে হাজির করছে মণ্ডপ রূপে। ৩৫টি বাড়িকে সাদা রং করে দেওয়া হয়েছে। বহুতল থেকে টালির বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে আসা হয়েছে এক ধাঁচে। বিভিন্ন বাড়ির জানলা-দরজার গ্রিলে বসানো হচ্ছে আনুষঙ্গিক নানা উপকরণ। এলাকার মধ্যিখানে এলোকেশী চুলে ধ্যানস্থ মা। শান্তি বিরাজ করবে এখানে।
পুরনোর মধ্যেই নতুনকে খুঁজে নিতে এ বার শুধু বেরিয়ে পড়ার অপেক্ষা।