বিলকান্দায় তৈরি হচ্ছে চোলাই। ছবি:সুদীপ ঘোষ
পুকুর পাড়ে চোলাই ভাটি। বস্তা দিয়ে ঘিরে রাখা, যাতে হাওয়া ঢুকতে না পারে। ভিতরে ইট-মাটির চুল্লি। সেগুলি দেখিয়ে ‘কারিগর’ জানালেন, প্রথমে ইস্ট দিয়ে গুড় পচিয়ে জাব তৈরি হয়। সেই জাব জালায় ভরে ডুবিয়ে রাখা হয় জলাশয়ে। এর পরে চুল্লিতে বড় হাঁড়িতে জল ফোটে। তার উপরে আর একটি হাঁড়িতে থাকে জাব। নীচের হাঁড়ির বাষ্প জাব-ভর্তি হাঁড়িকে গরম করে। জাবের হাঁড়ি থেকে বাষ্প জমে একটি নলের মধ্যে দিয়ে জমা হয় ড্রামে। সেটাই চোলাই। নিউ ব্যারাকপুর পুরসভা হয়ে বিলকান্দার তালবান্দার হেমন্তনগরে ঢুকতেই এই ভাটি। ড্রামের দিকে আঙুল দেখিয়ে আর এক কারিগর বললেন, ‘‘এটা খাঁটি চোলাই। এতে জল মিশিয়ে তৈরি হয় চোলাই মদ।’’ ছোট ছোট প্লাস্টিকের পাউচে বন্দি হয়ে ট্রেনে-বাসে-গাড়িতে চেপে সেই চোলাই মদ ছড়িয়ে যায় রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। যত দূরে যায়, ততই বাড়তে থাকে দাম। জয়নগরের মোয়া বা বর্ধমানের সীতাভোগের মতোই খড়দহ বিধানসভার বিলকান্দা, লেনিনগড়ের চোলাইয়ের কদর রাজ্য জুড়ে। সেই ছবি দেখা গেল এলাকায় ঢুকেই।
ঘটনাচক্রে বাম বা তৃণমূল, দুই জমানাতেই রাজ্যের অর্থ ও আবগারি দফতরের মন্ত্রীর নির্বাচনী কেন্দ্র খড়দহের এই বিলকান্দা। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্তকে হারিয়ে এই কেন্দ্র থেকেই নির্বাচিত অমিত মিত্র এখন অর্থমন্ত্রী। এ বারও তাঁরা এখানে পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রার্থী।
বিলকান্দার ছবিটা কিন্তু বদলায়নি। ভোটের বাজার ধরতে কখনও বৈধতার প্রতিশ্রুতি, কখনও বা বিকল্প কর্ম সংস্থানের আশ্বাস। কিন্তু সেটুকুই সার। কেউ কথা রাখেনি। ক্ষমতায় আসার পরে প্রতিশ্রুতি পূরণ করেনি কোনও দলই। বিলকান্দা রয়ে গিয়েছে বিলকান্দাতেই।
খড়দহ বিধানসভার অধীনে বিলকান্দা ছাড়াও লেনিনগড়, তালবান্দা, শহরপুরের কমপক্ষে হাজার পাঁচেক পরিবারের ২০ হাজার মানুষের পেশা চোলাই তৈরি। চোলাই তৈরি ছাড়াও কাঁচামাল আনা (গুড়, ইস্ট, কয়লা), চোলাই মদ প্যাকেটবন্দি করা, বাইরে নিয়ে বিক্রি মিলিয়ে এলাকার লক্ষাধিক মানুষ রয়েছেন এই কারবারে যুক্ত। এক বিক্রেতার কথায়, ‘‘আমরা সকলেই ভোটার। সব চেয়ে মজার কথা হল, বাম-তৃণমূল দুই জমানাতেই দেখা গিয়েছে, আমাদের ভোটে জেতা এই খড়দহের বিধায়কই গত ৪০ বছর ধরে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হয়েছেন। অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু সে সব কিছুই হয়নি।’’
বাম আমলে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত এ বারও বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্টের হয়ে লড়ছেন এই কেন্দ্র থেকেই। বিলকান্দায় প্রচুর মানুষ যে এখনও চোলাইয়ের সঙ্গে যুক্ত, স্বীকার করে নিয়েছেন তিনিও। চোলাইয়ের বৈধকরণ বা বিকল্প পেশার কী হল, প্রশ্ন করতে তাঁর জবাব, ‘‘আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে ওই শিল্পের বৈধতা দেবার চেষ্টা করেছিলাম। সেই মতো কারখানা তৈরির জমিও দেখা হয়েছিল। জলাশয়গুলি সংস্কার করে মাছ চাষের উপযোগী করার চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু পালাবদলের জন্য সে সব করা গেল না। বিলকান্দায় এই কাজটা প্রয়োজনীয়।’’
স্থানীয় মানুষ অবশ্য পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, এত বছরের বাম জমানায় এই কাজটা করা সম্ভব হল না কেন? বর্তমান সরকারই বা কী করছে?
এই কেন্দ্র থেকেই তৃণমূলের হয়ে লড়ছেন রাজ্যের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তিনি বলেন, ‘‘লাইসেন্সের ক্ষেত্রে অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে বলে চোলাইকে বৈধতা দেওয়া সম্ভব নয়। ক্ষমতায় আসার পর থেকে আমরা হানা দিয়ে চোলাই ভাটিগুলি বেশ কয়েক বার ভেঙে দিয়েছিলাম। এলাকায় উন্নয়নের অনেক কাজও হয়েছে। এখন ওই এলাকায় চোলাই তৈরি হয় না বললেই চলে। নির্বাচন কমিশন কিছু বলেছে বলেও শুনিনি।’’
বাম জমানা থেকে তৃণমূলের সরকার— চোলাই ভাটি ভাঙতে অভিযান হয়েছে বহু বার। চোলাই ভাটির সংখ্যাও এখন কিছুটা কমেছে। তবু লুকিয়ে-চুরিয়ে যা আছে, তা-ও কয়েক হাজার।
আগে যেখানে প্রত্যেক ঘরে ঘরে কুটির শিল্পের মতো চলত চোলাই তৈরি, এখন তাতে ভাটা। বারবার ভাটি ভেঙে দেওয়া, ধরপাকড়, বিভিন্ন ঝুট-ঝামেলা এড়াতে কেউ কেউ ফিরে গিয়েছেন অন্য পেশায়। আগে যে বিলকান্দায় ঢুকলে গোটা আকাশ জুড়ে দেখা যেত আগুনের ফুলকি, চোলাইয়ের তীব্র কটু গন্ধে গা গুলিয়ে আসত, কমেছে তা-ও। কালো কয়লার ধোঁয়ায় এলাকার কালো বাড়ি, শুকনো গাছ, কালো পুকুরের জলের মধ্যে কঙ্কালসার মানুষগুলোও বদলে গিয়েছেন অনেকটাই। এলাকায় রাস্তা, আলো হয়েছে। সে সব উন্নতির কথাই বলছেন শাসক দল তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা।
আর কী বলছেন স্থানীয় মানুষ?
এক যুবকের কথায়, ‘‘শুধু বারবার ভাটি ভেঙে আমাদের ক্ষতিই করা হয়েছে। ১৫ হাজার টাকার কাজ পেলে এই কাজ ছেড়ে দিতাম। বাবা কী করে জিজ্ঞাসা করলে ছেলেমেয়েরা স্কুলে চুপ করে থাকে। কে সাধ করে এমন কাজ করে বলুন!’’
বৈধকরণ বা বিকল্প কাজের প্রতিশ্রুতি বদলে যায়। ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি আসে, জানে বিলকান্দা। পরে যে-কে-সেই। পেটের তাগিদে ফের চুল্লি তৈরি করে চোলাই তৈরিতে নেমে পড়েন মহিলা-পুরুষ।