মাঠে ঘাস গজাতে দেননি সুভাষ!

এখন পার্কের পাঁচিলের গায়ে একাধিক রাজনৈতিক দলের দেওয়াল-লিখন। সেখানে ‘মহা মিছিল’ থেকে শুরু করে ‘গণতন্ত্র বাঁচাতে পদযাত্রা’র আহ্বান, সবই রয়েছে। তারই মাঝে ছোট ছেলেমেয়েরা ইতস্তত খেলাধুলো করছে। পাশের ঘেরা পার্কে ছোটদের খেলার কোনও সরঞ্জাম বসানোর কাজ চলছে। রয়েছে কলকাতা পুরসভার নিয়মাবলীর বোর্ডও।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪৯
Share:

ঐতিহাসিক: শ্রদ্ধানন্দ পার্কে এক জনসভায় সুভাষচন্দ্র বসু (বাঁ দিকে)। (উপরে) এখনকার শ্রদ্ধানন্দ পার্ক। আর্কাইভ ও নিজস্ব চিত্র

সারা মাঠে ঘাস নেই একটিও। রসিকতা চালু রয়েছে, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এখানে এত সভা করতেন যে মাঠে ঘাস গজাতে দেননি!

Advertisement

এখন পার্কের পাঁচিলের গায়ে একাধিক রাজনৈতিক দলের দেওয়াল-লিখন। সেখানে ‘মহা মিছিল’ থেকে শুরু করে ‘গণতন্ত্র বাঁচাতে পদযাত্রা’র আহ্বান, সবই রয়েছে। তারই মাঝে ছোট ছেলেমেয়েরা ইতস্তত খেলাধুলো করছে। পাশের ঘেরা পার্কে ছোটদের খেলার কোনও সরঞ্জাম বসানোর কাজ চলছে। রয়েছে কলকাতা পুরসভার নিয়মাবলীর বোর্ডও। ওই বোর্ডে ‘ফুলে, গাছে হাত দেবেন না’ থেকে শুরু করে ‘এমন কিছু করবেন না, যা অন্যের চোখে দৃষ্টিকটু লাগে’-সহ সতর্কবার্তা রয়েছে। ইতিহাস বলছে, ব্রিগেড-সংস্কৃতি চালুর আগে এই শ্রদ্ধানন্দ পার্কই ছিল শহরের রাজনৈতিক সমাবেশের অন্যতম ক্ষেত্র। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, প্রমোদ দাশগুপ্তের মতো নেতারা কখনও না কখনও এখানে সভা করেছেন। যেমন, ১৯২৮ সালে ২২ জানুয়ারি শ্রদ্ধানন্দ পার্কে একটি জনসভা হয়। সেখানে সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে কলকাতার তাবড় রাজনৈতিক বক্তারাও যোগ দিয়েছিলেন। ওই বছরেরই ১৩ এপ্রিল আরও একটি রাজনৈতিক সভা হয়। সেই সভাতেও সর্বভারতীয় নেতারা যোগ দিয়েছিলেন। ওই সময়ের আগে ও পরে এমন অজস্র সভা হয় ওই পার্কে।

এশিয়াটিক সোসাইটির পাবলিকেশন কমিটির সদস্য নির্বেদ রায় বলছেন, ‘‘দেশভাগের আগে পর্যন্ত উত্তর ও মধ্য কলকাতাই ছিল রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের মূল ক্ষেত্র। শ্রদ্ধানন্দ পার্ক ছিল ভরকেন্দ্র।’’ অবশ্য শুধু রাজনৈতিক সমাবেশ নয়, সে সময়ের পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, ১৯২৯ সালের ৯ জানুয়ারি নাগরিক সভা হচ্ছে সে মাঠে। আবার ১৯৪২ সালে ফ্যাসিস্ট বিরোধী সভারও সাক্ষী থাকছে ওই পার্ক। মাঠে রোদ-পোহানো এক বয়স্ক মানুষের কথায়, ‘‘এক সময়ে তো সব সভাই এখানে হত শুনেছি!’’

Advertisement

তোড়জোড়: চলছে ব্রিগেডের প্রস্তুতি। শুক্রবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

বাংলার মন্বন্তরের সময়ে ১৯৪৩ সালের ১৮ নভেম্বরের সরকারি হিসেব বলছে, কলকাতায় ২২৪৯ জন অনাহারে মৃত। ২৫ নভেম্বর ফেমিন কমিশনের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, এই এক দিনে ২৫ হাজার ২৮৮ জন মানুষ গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় এসেছেন। এই ঘটনাও এসে মিশেছিল শ্রদ্ধানন্দ পার্কে। কারণ, তার তিন দিন পরেই অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর সেখানে খাদ্য-সমস্যা নিয়ে সভা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এর পরে কখনও ‘সর্বভারতীয় রেলকর্মী দিবস’ পালন, আবার কখনও বিহারের বঙ্গভাষী অঞ্চল বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে উত্তাল হয়েছে এই মাঠ।

শ্রদ্ধানন্দ পার্কের পাশাপাশি একটা সময় পর্যন্ত দেশবন্ধু পার্ক, বিডন স্কোয়ার, কলেজ স্কোয়ার, চেতলা পার্ক, হাজরা পার্ক-সহ বিভিন্ন পার্কেই রাজনৈতিক সভা-সমাবেশগুলি হত। যেমন ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুভাষচন্দ্রের ডাকে দেশবন্ধু পার্কে জড়ো হয়েছিলেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। আবার তৎকালীন সংবাদপত্রে দেখা যাচ্ছে, সেখানেই লিলুয়া ধর্মঘটীদের সমর্থনে মে মাসে জনসভা হচ্ছে।

‘ক্যালকাটা: দ্য লিভিং সিটি’ বইয়ের ‘দ্য পলিটিক্যাল কালচার অব ক্যালকাটা’ প্রবন্ধে লেখক পার্থ চট্টোপাধ্যায় আবার জানাচ্ছেন, স্বাধীনতার আগে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সমাবেশ, এমনকি যেগুলিতে জাতীয় নেতারাও উপস্থিত থাকতেন, সেগুলিরও আয়োজন করা হত কোনও না কোনও হলে। ওই হলগুলির আসন সংখ্যা ছিল বড়জোর তিনশো-চারশো।

‘‘এ রকম দুশোটি কাঠের চেয়ার আছে আমাদের।’’ আই.এ (ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন) খোদাই করা পুরনো দিনের কাঠের চেয়ারগুলো গোছাতে গোছাতে কথাগুলো বলছিলেন অর্জুন দলুই। অর্জুনবাবু গত ৩৫ বছর ধরে ভারত সভার কেয়ারটেকারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এক সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সভা এই হলেই হয়েছে। এখন অবশ্য প্রসাধনী সংস্থার সম্মেলন থেকে সব অনুষ্ঠানের জন্যই হল ভাড়া দেওয়া হয়। ভারত সভার সভাপতি সত্যব্রত চৌধুরী বলেন, ‘‘এখনও অনেক রাজনৈতিক দল নিজেদের সভার জন্য হল ভাড়া নেয়। তবে বড় সভা তো আর হওয়ার জায়গা নেই।’’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, দেশভাগের পরে আর ছোট মাঠ বা হলঘরে আঁটছিল না জন সমাবেশ। তাই ব্রিগেডের মতো বৃহৎ ক্ষেত্রের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। অবশ্য ক্ষমতা ‘প্রদর্শনে’র জন্যও প্রয়োজন পড়েছিল বড় পরিসর। শহরের জনসংখ্যার বৃদ্ধি এই ক্ষেত্র বদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল বলে জানাচ্ছেন তাঁরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর বক্তব্য, আদর্শগত জায়গা নয়, বরং পাওয়া-না-পাওয়ার উপরে ভিত্তি করে রাজনীতির উপরে নির্ভরতা অসম্ভব বেড়েছে মানুষের। তাই কোনও রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে কোনও সুযোগ-সুবিধা যাঁরা পাচ্ছেন, তাঁরাই মাঠ ভরিয়ে দিচ্ছেন। আবার শহরের বাইরে থেকে যাঁরা রাজনৈতিক সভায় যোগ দিতে আসেন, তাঁদের কাছে কলকাতা একটি দেখার জায়গা, এক দিনের ঘোরার জায়গা। এক রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার কথায়, ‘‘আমরা জানি সমাবেশে যোগ দিতে আসা সমর্থকদের একটা অংশ শুধু শহর দেখতে আসেন। তাঁরা অনেক সময়ে সমাবেশেও আসেন না। কিন্তু এই যে এত লোক আসছেন, এটা তত ক্ষণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এটাই গুরুত্বপূর্ণ!’’

ফলে রাজনৈতিক সমাবেশের ক্ষেত্র হিসেবে ভারত সভা বা শ্রদ্ধানন্দ পার্কের উল্লেখ শুধু ইতিহাসেই থাকছে। আর এখন লোক যাচ্ছে ব্রিগেডে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement