আমার শহরের নাম হাওড়া। আমার স্কুল, আমার শৈশব, আমার কৈশোর, খেলার মাঠ, বয়ঃসন্ধি, বৈভব— সমস্তই হাওড়ার আনাচ-কানাচ ঘিরে। এমনকী, আমার জীবনচর্চা থিয়েটার-চর্যা হাওড়াতেই মূলত। তবু আমি প্রেমে পড়েছি বার বার শহর কলকাতার। যখন প্রেম কী বুঝিনি, তখনও! বাবার হাত ধরে কলকাতার এ গলি সে গলি-রাজপথ-অকুস্থল যত্ন করে ঘেঁটেছি আর অপার অনুযোগে বাবাকে বলেছি— ‘কলকাতায় থাকি না কেন আমরা! মনে পড়ে, যে ভাবে ‘রিডার’ বা ‘ক্যুইলপ’-এর কেট উইন্সলেটকে দেখতে রাতের পর রাত জাগা যায়, যে ভাবে সচিনের স্ট্রেট ড্রাইভকে ব্যাখ্যাতীত সুন্দরতম মনে হয়, যে ভাবে শঙ্খ ঘোষকে পঞ্চাশ গজ দূর থেকে দেখলেও অপার্থিব কেউ মনে হয়— ঠিক সে ভাবেই শহর কলকাতাকে এক স্কুলপড়ুয়া অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের কী এক ইলিউশনের মতো মনে হতো। তাই হয়তো কলকাতামুখী বাসটা যখন রবীন্দ্রসেতু পেরতো তখন গঙ্গাদর্শনে যে উত্তেজনা আনন্দ হত, তার সিকিভাগও হত না হাওড়ামুখী বাসটা যখন রবীন্দ্রসেতু পার হত। তখন আমি বাবার কাঁধে মাথা দিয়ে গভীর ঘুমে কিংবা আধঘুমে। মাথায় ঘুরছে হয়তো অ্যাকাডেমির ঠান্ডা ঘরে ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’-র গৌতম হালদার-এর সেই ঘুঙুর কিংবা মঞ্চে রাখা ওই ধনুকের মতো কী একটা অথবা চাপদাড়িওয়ালা লম্বা মতো যাঁকে ঘাড়টা অনেকটা উঁচু করে দেখতে হয় সেই মানুষটির কথা, যিনি অনেকগুলো সন্দেশ খাওয়ালেন, যাকে বাবা ‘রুদ্র’ বলে ডাকছিল, কিংবা হয়তো মাথায় ঘুরছে বাগবাজার ঘাটের ট্রামলাইন বা শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের ইয়াব্বড় ঘোড়ার ল্যাজ বা ভিক্টোরিয়ার সাদা পরি। ঘোর লেগে যেত, চোখ খুললে এসে পড়ত হাওড়া ময়দান। ইলিউশন শেষ। পর্দা নেমে আসত। আর দেখতাম বাবা কাঁধের কাছে জামাটা রুমাল দিয়ে মুছছে। বাসে-ট্রামে ঘুমিয়ে পড়লে আমার লালা পড়ত! তার পর বাবা বলত, ‘আজ যা যা দেখলে, যে যে রাস্তা চিনলে— সব ডায়েরিতে লিখবে।’ ফিরে এসে শুরু হত শহর কলকাতার পথে আমার আলাপচারণ। ডায়েরিতে আঁকিবুঁকি। সেই সব দিন, সেই সব অনুভব আবেগের স্মৃতি গতকাল অভিজাত কলকাতার কোনও এক ‘শপিং মল’-এ করা ডিনারের চেয়েও অনেক বেশি জ্যান্ত, সত্য।
হ্যাঁ, শহর কলকাতার সঙ্গে আমার প্রেমের সূত্র বাবা-ই। শীতের কোনও এক সকালে তখন হয়তো বাবরি মসজিদ ভেঙেছে কিংবা হয়তো আম-বাঙালিকে জীবনমুখী করছেন কোনও এক সুমন চট্টোপাধ্যায় কিংবা রাইটার্সের সামনে চিকেন বিরিয়ানি বিকোচ্ছে আঠারো টাকায় আর সেই সময় বাবার হাত ধরে কমলালেবু হাতে ইডেনে। স্বপ্নের ইডেন আমার। বাংলার রঞ্জি ম্যাচ। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-মহামেডান মাঠ। সবুজ ঘাসের গন্ধ। কেঠো গ্যালারির ধুলো। চিনে বাদামের খোলা। বাইচুং ভুটিয়া। সব শেষে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন-বেলেঘাটা বাইপাস-উল্টোডাঙা থেকে সার বেঁধে সিগন্যালে আটকে পড়া লাল-হলুদ, সবুজ-মেরুন ম্যাটাডর। বাকযুদ্ধ। পাশে বাবা। কানে আঙুল। মাঠে ঢোকার সময় দৌড়নো, বুকের মধ্যে গুমগুম। ভিক্টোরিয়া, যাদুঘর, তারামণ্ডল— এ সবের সঙ্গে নয়, আমার কলকাতা প্রেম সবুজ মাঠকে ঘিরে। সে ইডেনেই হোক কিংবা যুবভারতী। পড়ার বই নয়, ক্লাসরুম নয়, কৈশোর কেটে গেছে কলকাতা শহরের মাঠের স্বপ্ন দেখতে দেখতে।
গোঁফের রেখা উঁকি দিল। একা একা গঙ্গা পার শুরু হল। জার্সি কিনতে বিধান মার্কেট। যখন তখন কলেজ স্ট্রিট বন্ধুদের সঙ্গে। বই কিনতে নয়, ব্যাট উইকেট কিপিং-গ্লাভসের খোঁজে। ফাঁকতালে ঢুকে পড়া কফি হাউস। মনে হত অন্য জগৎ। অদ্ভুত সব লোক। বেশি যাইনি আর। তখন তো চোখ জুড়ে সবুজ মাঠের গ্ল্যাডিয়েটর হওয়ার স্বপ্ন— ইডেন।
থিয়েটারীয় বাড়ি তো! তাই অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্রসদন যাতায়াত চলতই। একঘেয়ে লাগত জায়গাটা। সত্যি। বরং ভাল লাগত গিরিশ মঞ্চ। সেই বয়সে বুঝিনি— উত্তর কলকাতার সঙ্গে নিবিড় প্রেম গড়ে উঠবে পরে!
লেখালেখির অভ্যাস ছিল একটু-আধটু ছোট থেকেই। বাবা লিখতো তো। পাকেচক্রে দু’-একটা লিট্ল ম্যাগ-এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। আমি তখন ইলেভেন। লিটল ম্যাগাজিন মেলা। নন্দন চত্বরটাকে নতুন মনে হয়েছিল। নতুন বন্ধু— সবাই কবি— বয়সে বড় বেশির ভাগ, অনেকটাই। নতুন সঙ্গ। খেলার মাঠের সঙ্গীদের চেয়ে একেবারে আলাদা। ওই সময়ই তারা আমায় নিয়ে গিয়েছিল একেবারে অচেনা একটা জায়গায়। তখন শুনেছিলাম জায়গাটার নাম চেতলা। এ গলি সে গলি ঘুরে তাদের ঠেক। বাংলা মদের গন্ধ, গাঁজার ধোঁয়া। অদ্ভূত কথোপকথন। কাঁচা বয়সের আমি কথার ফাঁকে আড়ালে উঠে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কিচ্ছু চিনি না। পথচলতিদের সাহায্যে অনেকটা হেঁটে পৌঁছেছিলাম হাজরা রোড। তারপর বাস ধরে বাড়ি। রাত গড়িয়েছিল। সেই প্রথম কলকাতা শহরে নিরাপত্তার অভাব বোধ করেছিলাম। লোকগুলোকে নয়, শহরটাকে খুব ভয় হয়েছিল। জানি না কেন! তারপর রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হলাম। জোড়াসাঁকো। কিছু অভিজ্ঞতা হয় যেগুলো ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে এলোমেলো হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটিতে আমার যে প্রচুর বন্ধু হয়েছে এমন নয় কিন্তু। জোড়াসাঁকোর প্রতিটি কোণ, আনাচ-কানাচ আমার বন্ধু হয়েছে। ডায়লগ তৈরি হয় ওদের সঙ্গে। হয়তো শুনতে কাব্যিক লাগছে। কিন্তু এ আক্ষরিক সত্য।
তত দিনে আমি অনেকটা বদলেছি। মাঠের আমি বদলে শান্ত হয়েছি। সর্বক্ষণের থিয়েটার প্র্যাকটিশনার হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। নতুন শখ হয়েছে, কলকাতার রাস্তা চেনা। উত্তর কলকাতার এ-গলি সে-গলি উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতাম। দক্ষিণেও বেড়িয়েছি। একা একা। নতুন করে শহরটার প্রেমে পড়েছি। সে সব অনুপুঙ্খ বলতে গেলে ব্যাসদেব হয়ে যাব। থাক। কিন্তু আজও আমায় অক্সিজেন জোগায় বাগবাজার ঘাট, আহিরীটোলা, ট্রামলাইন। এখন যেমন মন খারাপ হলে মদ্যপান, উৎসব হলেও মদ্যপান। আমার তেমনই মন খারাপ হলেও বাগবাজার ঘাট, নাটকের খসড়াও বাগবাজার ঘাটের পোড়া গরমেই। আর যুবভারতী চত্বর। মনে পড়ে চার বন্ধু আড্ডা দিচ্ছি যুবভারতীর চার নম্বর গেটের ভিতর। সন্ধ্যা নেমেছে। নেশা করছি ভেবে পুলিশের তাড়া। ঊর্ধ্বশ্বাস উসাইন বোল্ট। বাইরে এসে আমাদের বিজয়োল্লাস। স্মৃতি চোখ ভেজায়।
উত্তর কলকাতার সঙ্গে তো আমার দাম্পত্য ঘটেইছে। তবু আজও মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ি বাটা-রাজস্থান কিংবা কালীঘাট মাঠের সামনে। সাদা জামা পরে ক্লাব ক্রিকেট চলছে। যে ভাবে পরস্ত্রী দেখে মানুষ। এ জন্মে তো আর খেলোয়াড় হওয়া হল না। তবে শহর কলকাতার সঙ্গে আমার আপাতত শেষতম প্রেম পার্ক স্ট্রিট কবরস্থান। একটা আশ্চর্য বিপুল নিশ্চিন্তি কাজ করে এখানে। আমার দল ‘নটধা’র সাম্প্রতিকতম নাট্য ‘অথৈ’-এর বেশ কিছু ‘ভিস্যুয়াল’-এর প্রেরণা এই স্থান। মাঝে মাঝেই যেতে ইচ্ছা হয়। চুপ করে বসে ভাবতে সাধ হয়। আর এখানে এলেই অদ্ভুত অনুভব হয়— মনে হয় আগে যেন বহু বার এসেছি এখানে। জাতিস্মর মনে হয় নিজেকে। মনে হয়, ইস্, যদি ‘হ্যামলেট’টা এখানে করা যেত!
আমার থিয়েটার চর্চা চলছে, চলবেও। নীল-সাদা কলকাতা প্রতিদিন বদলাচ্ছে, বদলাবেও। তার সঙ্গে আমার প্রেম অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যেমনটা হয়। যার হাত ধরে প্রথম গঙ্গাপার হওয়া— সেই বাবার হাতটাই আর ধরা হয় না। তবুও হঠাৎ কোনও একটা খারাপ রিহার্সাল বা খারাপ অভিনয় কিংবা থিয়েটারেরই কোনও অগ্রজের অনাদর প্রকাশের পর কিংবা একটা অবশ্যম্ভাবী অবসাদগ্রস্ততা হঠাৎ হঠাৎ যখন গিলে খেতে চায় তখন হয়তো কোনও এক ঠাস-ভিড় বাসে জানালার ধারে বসে ক্রমশ অচেনা হতে থাকা শহরের রাস্তাগুলোর মধ্যে দিয়েই মুহূর্তগুলো সমাহিতি খুঁজে বেড়ায়। যেমনটা ঘটত ছোটবেলায় সারাদিন স্কুল-খেলায় মেতে থাকা রোজনামচার মধ্যে হঠাৎ রেজাল্ট খারাপ হলে কিংবা বন্ধুর সঙ্গে ঝামেলা হলে যেমন মায়ের আঁচল খুঁজে বেড়াতাম— ব্যাপারটা হয়তো খানিক তেমনই।
তাই মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয়, যদি সেই সাড়ে নব্বইয়ের কলকাতাটাকে আবার খুঁজে পাওয়া যেত!