কলকাতার আর্মেনিয়ান চার্চে ক্রিসমাস।
শীতের ঝকঝকে দিন আর হিমেল রাতে আলোর পরশ বুলিয়ে এ বছরের মতো চলে গিয়েছে ক্রিসমাস। ঝলমলে আলোয় সেজে ওঠা পার্ক স্ট্রিট, প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা বো ব্যারাক অথবা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান কমিউনিটির সঙ্গে, এই ২৫ ডিসেম্বরটা সারা কলকাতারই বড় আদরের দিন। কিন্তু এর কয়েকটা দিন পরেই, এই শহরের জন্ম থেকে বসবাসকারী আর এক সম্প্রদায় প্রায় নিঃশব্দে নিজেদের মত করে পালন করে তাদের বড়দিন, সে খবর কলকাতা এখন রাখে না বললেই চলে।
আর্মেনিয়ানরা ২৫ ডিসেম্বরের বদলে প্রতি বছরই বড়দিন পালন করেন ৬ জানুয়ারি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে আসার বহু আগে, সুদূর আর্মেনিয়া থেকে এ দেশে এসে বসবাস শুরু করেন আর্মেনিয়ানরা। ব্যবসার জন্য আকবর তাঁদের ভারতে আহ্বান করেন। পরে ইংরেজদের সঙ্গেও সহাবস্থানে কোনও অসুবিধা হয়নি শান্তিপ্রিয় আর্মেনিয়ানদের।
পশ্চিম এশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের সংযোগস্থলে হওয়ায়, আর্মেনিয়ার উপর দিয়ে প্রচুর রাজনৈতিক ঝড়ঝাপটা গিয়েছে বারবার। একসময় আর্মেনিয়ার কুখ্যাত গণহত্যার জেরে সে দেশ থেকে দলে দলে মানুষ এ দেশে চলে আসেন। ক্রমে কলকাতা এঁদের প্রধান আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। আর্মেনিয়ান অর্থোডক্স চার্চের নিয়মানুসারে, প্রতি বছর ৬ জানুয়ারি দিনটি জিশুর জন্মদিন এবং ব্যাপটিজমের দিন হিসাবে পালন করেন কলকাতাবাসী আর্মেনিয়ানরা। প্রসঙ্গত, শুধু আর্মেনিয়ান অর্থোডক্স চার্চ নয়, বহু আগে আরও অনেক চার্চই বড়দিন পালন করত ৬ জানুয়ারি। রোমান সাম্রাজ্যের উত্থানের পর ইউরোপে বড়দিন পালিত হতে থাকে ২৫ ডিসেম্বর। কিন্তু আর্মেনিয়ানরা তাঁদের ঐতিহ্য থেকে সরে আসেননি। তাঁরা পুরনো মতেই পালন করতে থাকেন তাঁদের ক্রিসমাস।
আর্মেনিয়ান কলেজে ক্রিসমাসের খাওয়াদাওয়া।
আরও পড়ুন: রাজ্যের দুর্গাপুজোতেও এ বার নজর আয়করের, ৪০টি প্রধান পুজো কমিটিকে তলব
একটা সময় ২৫ ডিসেম্বরের থেকে জাঁকজমক আর উৎসব অনুষ্ঠানে কিছুমাত্র পিছিয়ে থাকত না আর্মেনিয়ান ক্রিসমাসের দিনটি। দামি রত্ন, অলংকার, জাহাজ, সূক্ষ্ম বস্ত্র আর নীল চাষের মত বেশ কিছু ব্যবসার কারবারি আর্মেনিয়ানদের বেশির ভাগই ছিলেন অত্যন্ত ধনী। জোহানস গলস্তাউন নামে এক আর্মেনিয়ান কলকাতার প্রায় ৩৫০টি অট্টালিকা তৈরি করেন। তাঁর ঘোড়া দাপিয়ে বেড়াত রেসকোর্সে। তাঁকে বলা হত কলকাতা রেসকোর্সের রাজা। নিজাম প্যালেস তিনি তৈরি করেন। হুজুরিমাল বা মানভেল হাজার মালিয়ান তৈরি করেন আর্মেনিয়ান ঘাট। জলপথে মশলা আর পাথরের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ঘাটটি তৈরি হয়। আরাথুন স্টিফেন ছোটখাটো গ্র্যান্ড হোটেল কিনে নিয়ে আজকের রূপ দেন।
বলাই বাহুল্য, সে সময় এ হেন ধনীদের সব থেকে বড় উৎসব কতটা আলো ছড়িয়ে দিত কলকাতার গায়ে! এই দিনের প্রস্তুতি শুরু হত বহু আগে থেকে। ঘরদোর পরিষ্কার করে নতুন রংয়ের পোচ লাগানো হত দেওয়ালে। ক্রিসমাস ট্রি, ঝকঝকে উজ্জ্বল ক্রিসমাস স্টার শোভা বাড়াত অন্দর সজ্জার। ক্রিসমাস ইভে বিশেষ খাওয়াদাওয়ার সাথে সাথে পরের দিনের জন্য কেক তৈরির সরঞ্জাম তৈরি রাখা হত। বড়বাজারের কাছে আর্মেনিয়ান চার্চ অফ হোলি ন্যাজারেথে ক্রিসমাসের সকালে অজস্র ঘোড়ার গাড়ি আর মোটর গাড়ি এসে পৌঁছত। ধর্মতলা থেকে বড়বাজারের পর্যন্ত পুরো রাস্তা পরিষ্কার করে সুন্দর সাজিয়ে ফেলা হত। প্রার্থনা সেরে চার্চে মৃতদের সমাধিতে ফুল দিয়ে বাড়ির পথ ধরতেন সবাই। বিকেলে উপহার নিয়ে একে অপরের বাড়ি যেতেন। রাতে বিরাট ক্রিসমাস পার্টির আয়োজন হত ফিরপো’জ, গ্রেট ইস্টার্ন বা গ্র্যান্ড হোটেলে। ডাকসাইটে আর্মেনিয়ান সুন্দরীরা আসরগুলির মধ্যমণি হয়ে থাকতেন। বাচ্চাদের কলহাস্যে মুখরিত হয়ে থাকত পার্টিগুলি। বহু দূরে নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে আসার কষ্ট মনে থাকত না কারওরই।
সুজান রুবেনের পরিবার।
আরও পড়ুন: রাফাল নিয়ে নির্দিষ্ট প্রশ্ন ছুড়লেন রাহুল, জবাব এড়িয়ে আবেগকে ঢাল করলেন নির্মলা
আজকের আর্মেনিয়ান ক্রিসমাস সেই সব সোনালি দিনের ধূসর ছায়ামাত্র। ব্রিটিশরা যখন এ দেশ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে চলে যায়, তখনও কলকাতায় ৩০ হাজার আর্মেনিয়ান ছিলেন। এখন সেই সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ৮০ থেকে ১০০ জনে। সে দিনের সেই সুন্দরীরা এ দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন কবেই। যে কয়েকজন আছেন, তাঁদের এখন ঠাঁই হয়েছে পার্ক সার্কাসের ‘স্যর ক্যাচিক পল চ্যাটার হোম ফর এলডারলি’ নামে আর্মেনিয়ানদের জন্য তৈরি এক বৃদ্ধাশ্রমে। খাঁখাঁ বৃদ্ধাশ্রমে কয়েকজন মাত্র আবাসিক। এঁরা কেউ নিঃসন্তান, কারও সন্তান কাজের খাতিরে অন্য দেশে। এ দেশের মায়া ছাড়তে পারেননি এঁরা। অধিকাংশই বৃদ্ধ, অসুস্থ, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। যাঁরা এখনও হাঁটতে পারেন, তাঁরা বৃদ্ধাশ্রম সংলগ্ন সেন্ট গ্রেগরি চ্যাপেলে বড়দিনের প্রার্থনা করেন। এঁদের অনেকেরই এ দেশেই জন্ম। আর্মেনিয়া কখনও যাননি। এই দিনটিতে দেশ বিদেশের আত্মীয় পরিচিতরা ফোন করে খবর নেন, শুভেচ্ছা জানান। ফোন আসে পূর্বপুরুষের দেশ আর্মেনিয়া থেকেও। চোখ জলে ভরে আসে, শূন্য লাগে বড়। এঁদের ক্রিসমাস কাটে এ ভাবেই। নিঃসঙ্গতায়, নস্টালজিয়ায়।
মির্জা গালিব স্ট্রিটে আর্মেনিয়া কলেজের হস্টেলেও অনেক আর্মেনিয়ান ছাত্রছাত্রী থাকে। নামে কলেজ হলেও, শিক্ষার্থীর অভাবে এখন দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এখানে। ঐতিহ্যবাহী এই কলেজে এখন মাত্র ৭৪ জন ছাত্রছাত্রী আর্মেনিয়ান। তবে এদের সঙ্গে কলকাতার তেমন কোনও নাড়ির যোগ নেই। এঁরা প্রায় সবাই আর্মেনিয়া থেকে এখানে পড়তে এসেছে। প্রতি বছরই এমন অনেক ছেলেমেয়ে আসে। পড়া শেষ করে কয়েক বছর পর আবার চলেও যায়। এই আবাসিক ছাত্রছাত্রীরা, কলেজের স্টাফরা, তার সঙ্গে বাকি কলকাতায় ছড়িয়ে থাকা কিছু আর্মেনিয়ান পরিবার উৎসাহের সঙ্গে পালন করেন তাঁদের বড়দিনটা।
আর্মেনিয়ান চার্চে ক্রিসমাস।
এ দেশে আর্মেনিয়ানদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসায়, অনেক আর্মেনিয়ানই এখন বিয়ে করেন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, পঞ্জাবি অথবা সিন্ধিদের। ২৫ ডিসেম্বর আর ৬ জানুয়ারি, এই দু’দিনই তাঁদের কাছে বড়দিন। আর্মেনিয়ান চার্চের ওয়ার্ডেন সুজান রুবেন যেমন এ দেশেই জন্মেছেন। বিয়ে করেছেন অ্যংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে। ২৫ ডিসেম্বর পরিবারের সবাই একসাথে বড়দিন হিসাবে পালন করলেও, ৬ জানুয়ারির গুরুত্ব তাঁর কাছে আলাদা। বাপের বাড়ির সবাই বছরে এই একবার মিলিত হন, আনন্দ করেন। বিদেশের অন্যান্য জায়গায় থাকা আর্মেনিয়ান আত্মীয়রা কখনও কখনও চলে আসেন এ দেশে, সুসানের কাছে।
আন্দ্রোনিক জেভরগ্যান এবং তাঁর স্ত্রী দুজনেই আর্মেনিয়ান। নিজেদের দেশ ছেড়ে কলকাতায় আছেন প্রায় বছর পনেরো। যখন প্রথম এ দেশে এসেছিলেন, তখনও খানিকটা ঝলমলে ছিল উৎসবের দিনগুলি। এখন সেই রংটুকুও মুছে নিয়েছে সময়। তবে তাতে আন্তরিকতা আর আচার অনুষ্ঠানে কিছুমাত্র ফাঁক পড়তে দেননি তাঁরা।
ক্রিসমাসের আগের এক সপ্তাহ উপবাস করার চল রয়েছে আর্মেনিয়ানদের মধ্যে। এখন নিয়ম খানিকটা শিথিল হলেও, এই সময় আমিষ একেবারেই খান না তাঁরা। ২৫ ডিসেম্বরের সময় কলকাতায় যখন বড়দিনের বাজার বসে, তখনই বাড়ি সাজানোর হরেক উপকরণ কিনে ফেলেন সবাই। সেই সবগুলিই কাজে লেগে যায় তাঁদের বড়দিনের আগে। ক্রিসমাস ট্রি সেজে ওঠে। তাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ছোট্ট ছোট্ট তারা আর নানা রংয়ের বল। উপহারের প্যাকেটও রেডি করে ফেলা হয়। ক্রিসমাস ইভে বাচ্চাদের জন্য সান্তাক্লজ এসে হাজির হয় উপহারের ঝুলি নিয়ে। সারা সপ্তাহ স্বল্পাহারের পর বড়দিনের আগের রাতে হালকা খাওয়ারের নিয়ম আর্মেনিয়ানদের। ক্রিসমাস ইভের খাওয়া দাওয়াকে বলা হয় ‘খেতুম’। মাছ, কিসমিস-কাজুবাদাম-ঘি-মিষ্টি দিয়ে তৈরি ভাত আর নানা রকম পানীয় খাওয়া হয় এই দিন। ধনে, তেজপাতা, গোলমরিচ দিয়ে স্মোকড মাছের পদটিকে বলা হয় প্রিন্সলি ট্রাউট। তবে কলকাতায় ট্রাউট পেতে অসুবিধা হয় বলে যে কোন কাঁটা ছাড়া মাছ দিয়ে পদটি রান্না করা হয়। খেতুমের পানীয়টি বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম হয়। কলকাতায় পালংশাক পিষে মাখনে নাড়াচাড়া করে, মশলা দিয়ে পানীয় হিসাবে পরিবেশিত হয়। আর থাকে ওয়াইন। সারা বছর যাতে সুখে আর মিষ্টি মুখে কাটে, তার জন্য আখরোটের গায়ে আঙুরের জেলি দিয়ে ‘রেজিক’ বলে একরকম জিনিস তৈরি করা হয়। তারের মত করে বাড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এগুলি। এছাড়াও গম, বার্লি এবং ড্রাই ফ্রুট দিয়ে তৈরি হয় পুডিং। আর্মেনিয়ানদের ক্রিসমাস কেকের নিজস্ব বৈশিষ্ট আছে। স্পঞ্জের মত এই কেক বরাবর নিজেরাই তৈরি করেন এঁরা। ক্রিসমাসের দিন ভেড়ার মাংস আর চাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিলাফ। সেই সঙ্গে খাওয়া হয় ময়দা-মধু-ডিম-মাখন-দারচিনি দিয়ে বানানো চমৎকার ডেজার্ট বাকলাভা।
আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অফ নাজারেথ।
আর্মেনিয়ায় কলেজের কো অর্ডিনেটার আরমেন মাকেন জানালেন, ক্রিসমাস ইভের রাতে কলেজের সব ছাত্রছাত্রী এবং অন্যান্য আর্মেনিয়ানরা প্রথা মেনে একবার চার্চে যান, মর্ত্যে জিশুর আগমনকে স্বাগত জানানোর জন্য। ক্রিসমাসের দিন সকাল ৯টার মধ্যে ফের চার্চে পৌঁছে যান সবাই। কলকাতার প্রাচীনতম গির্জা হিসাবে ধরা হয় আর্মেনিয়ান হোলি চার্চ অফ নাজারেথকে। ১৬৮৮ সালে তৈরি হওয়া চার্চটি ১৭০৭ সালে এক ভয়ঙ্কর আগুনে পুড়ে যায়। ১৭২৪ সালে পুনর্নির্মাণ করা হয় এটিকে। এইখানেই রয়েছে রেজাবিবে সুকিয়ার সমাধি, যেটিকে অনেকে কলকাতার প্রাচীনতম খ্রিস্টান সমাধি বলেন। দেখার মত সুন্দর এই চার্চটির মূল বেদী এ দিন ক্রিসমাস উপলক্ষে নানা রকম ফুল, আলোর মালা আর বাতি দিয়ে ভারি সুন্দর করে সাজান হয়। আর্মেনিয়ান চার্চের প্রধান আর্মেনিয়ান ভাষাতেই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তাঁর সঙ্গে থাকেন আর্মেনিয়ান কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। গম্ভীর আর পবিত্র সেই মন্ত্রোচ্চারণে গমগম করে ওঠে বিশাল গির্জার উঁচু ছাদ, প্রতিটি কোনা। দোতলার ব্যালকনি থেকে ক্রিসমাস কয়ারের মিষ্টি সুর ভেসে আসে। আর্মেনিয়ান ক্রিসমাসের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ‘ব্লেসিং অফ ওয়াটার’। জর্ডন নদীতে জিশুর ব্যাপটিজমকে স্মরণ করে এই অনুষ্ঠান করা হয়। অনুষ্ঠান চলাকালীন ক্রস বারবার জলে ডুবিয়ে শেষে সেই ক্রস ওষ্ঠে ঠেকিয়ে সেই জল পান করেন আর্মেনিয়ানরা।
সন্ধেবেলা ময়দানের আর্মেনিয়ান স্পোর্টস ক্লাবে মিলিত হন সবাই। নাচ গান খাওয়া দাওয়া নিয়ে জমজমাট পার্টি চলে রাত পর্যন্ত। কলকাতায় বড় হয়ে উঠে এখন যাঁরা কাজের সূত্রে বিদেশে থিতু, তাঁরা আজও ভোলেননি তাঁদের শৈশব কৈশোরের শহরকে। এই দিনটার টানে প্রতি বছরই তাঁরা আসার চেষ্টা করেন কলকাতায়। আর্মেনিয়ানদের ক্রিসমাস আজও একসূত্রে বেঁধে রাখে কলকাতা আর আর্মেনিয়াকে।
ছবি: আর্মেনিয়ান কলেজের সৌজন্যে।