ফাইল চিত্র।
গত লোকসভা নির্বাচনে গোটা দেশে ৭৮ জন মহিলা জনপ্রতিনিধির নির্বাচিত হওয়ার ঘটনাকে অনেকেই রাজনীতিতে মহিলা প্রতিনিধিত্বের ‘উজ্জ্বল দিক’ হিসেবে বিজ্ঞাপিত করতে চাইছেন। সত্যিই কি পরিস্থিতি এতটাই আশাব্যঞ্জক?— এমনই প্রশ্ন উঠছে সমাজের একাংশে।
কারণ, অতীতে একাধিক বার চেষ্টা হলেও এখনও লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসনের বাধ্যতামূলক সংরক্ষণের বিল পাশই করানো গেল না। কেন্দ্রের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার গত লোকসভা নির্বাচনের সময়ে নিজেদের ইস্তাহারে মহিলাদের জন্য ৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কথা বললেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘৩৩ শতাংশ আসন সংরক্ষণ এখনও শুধুমাত্র পঞ্চায়েত ও পুর নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে। লোকসভা ও বিধানসভায় সেই আইন প্রণয়ন করা গেল না।’’
যার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে ‘ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন’-এর রিপোর্টে (১ জানুয়ারি, ২০২১)। রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণের নিরিখে ১৮৮টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪৮! যদিও এক সমাজতাত্ত্বিকের কথায়, ‘‘রাজনীতিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ আর সমাজে মহিলাদের অবস্থাকে এক করে দেখাটা বোধহয় সরলীকরণ হয়ে যাবে। কারণ, তালিকায় তো পাকিস্তানও (১১৬তম স্থানে) ভারতের থেকে এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু সেখানকার সমাজে মহিলাদের পরিস্থিতি তো এ দেশের থেকে
ভাল নয়।’’
তবে অনেকেই মনে করছেন, বেশি সংখ্যক নারী রাজনীতিতে প্রবেশ না করলে বা নীতিগত সিদ্ধান্ত না নিলে নারীর ক্ষমতায়ন শুধুমাত্র তাত্ত্বিক পরিসরেই থেকে যাবে। কারণ, ১৯৯৭ সালে এ দেশে লোকসভায় মহিলা জনপ্রতিনিধিত্বের শতকরা হার ছিল ৭.২, সেটা দু’দশক পরে দ্বিগুণ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ১৯৬২-২০১৯, এই ৫৭ বছর সময়সীমায় মাত্র ৬১৭ জন মহিলা জনপ্রতিনিধি লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছেন। ওই একই সময়সীমায় দেশের ২৬৪টি লোকসভা কেন্দ্র থেকে কখনও কোনও মহিলা প্রার্থীই নির্বাচিত হননি!
মহিলা প্রার্থীদের নির্বাচিত না করার ক্ষেত্রে কী মানসিকতা কাজ করে, তা বোঝাতে গিয়ে অনেকে অতীতের ‘ভায়োলেন্স এগেনস্ট উইমেন ইন পলিটিক্স’ (ভিএডব্লিউপি) নিয়ে ‘ইউনাইটেড নেশনস এনটিটি ফর জেন্ডার ইকুয়ালিটি অ্যান্ড দ্য এমপাওয়ারমেন্ট অব উইমেন’ (ইউএন উইমেন) এবং ‘সেন্টার ফর সোশ্যাল রিসার্চ’-এর সমীক্ষার প্রসঙ্গটি টেনে আনছেন। সমীক্ষার আওতায় আসা ৫৩ শতাংশ মানুষই মনে করেন, মহিলার পরিবারই ঠিক করবেন তিনি দলীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করবেন কি করবেন না। ৭৭ শতাংশ মানুষ মনে করেন, মহিলা প্রার্থীরা রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত নন বা তাঁদের জনসংযোগের প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই। সেই কারণে মহিলা জনপ্রতিনিধির বাবা বা স্বামীকে নেপথ্যে থেকে (প্রক্সি পজিশন) সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর শিল্পা সাউ বলছেন, ‘‘মহিলা-প্রধান রাজ্যের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই দেখা গিয়েছে যে, তাঁরা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামোর মানোন্নয়ন-সহ সাধারণ মানুষের দাবি বোঝার ক্ষেত্রে অনেক বেশি সংবেদনশীল হন।’’
অথচ পরিসংখ্যান দিয়ে গবেষকদের একাংশ জানাচ্ছেন, ১৯৯৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ২৮৪ জন মহিলা প্রার্থীর মধ্যে ৪৯ জন জিতেছিলেন। ২০০৪ ও ২০০৯ সালে যথাক্রমে ৩৫৫ জন ও ৫৫৬ জন মহিলা প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচিতের সংখ্যা ছিল ৪৫ এবং ৫৯ জন। এক গবেষকের কথায়, ‘‘২০১৪ সালে লোকসভায় নির্বাচিত মহিলা প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ৬১। যদিও ভারতের মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশই হল নারী। ফলে সেই তুলনায় ওই সংখ্যাটা নগণ্য।’’
একই প্রতিচ্ছবি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেও।— ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা ১১৪ জন মহিলা প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ২৮ জন মহিলা বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৬ ও ২০১১ সালে নির্বাচিত মহিলা জনপ্রতিনিধির সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ৩৭ এবং ৩৪ জনে। ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে ৪০ জন হলেও রাজ্যে মোট আসনের নিরিখে মহিলা প্রতিনিধিত্বের শতকরা হার মাত্র ১৩.৬!
গত বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে শাসকদলের প্রার্থী তালিকায় মহিলা প্রতিনিধির শতকরা হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। সেই ক্ষমতাসীন দল শুক্রবার তাদের প্রার্থী তালিকা সামনে আনার পরে দেখা যাচ্ছে, তা দু’শতাংশ বেড়ে প্রায় ১৭ শতাংশ হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূল সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় বলছেন, ‘‘লিঙ্গবৈষম্য হল এক ধরনের মৌলবাদী প্রথা। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভাবে মহিলা প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বী করেই নয়, বরং সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সেই প্রথা আমরা দূর করতে চাই। কিন্তু এটা এক দিনে হবে না। এ জন্য সময় লাগবে।’’
রাজনীতির আঙিনায় পুরুষ প্রতিনিধিত্বের প্রাধান্য ভুলে নারীদের অংশগ্রহণে সাম্য আনতে আরও কতটা সময় লাগবে? সে উত্তরও আপাতত সময়ের গর্ভেই রয়েছে!
(শেষ)