আলোচনায় র্শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও স্মরণজিত চক্রবর্তী
শ্রাবস্তী ঘোষ
‘যে কোনও ঘটনার অভিঘাতে সঙ্গে সঙ্গে লিখলে, তা সাহিত্য হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কম থাকে, তা হয়ে যায় অনেকটা সংবাদপত্রের লেখার মতো‘, তাই করোনার আঘাত নিয়ে এখনও তেমন কিছু লেখার কথা ভেবে উঠতে পারেননি বললেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন ও আখর কলকাতার যৌথ উদ্যোগে ২০ জুন আয়োজিত র্শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সন্ধ্যার শুভারম্ভ হল এই কথার মাধ্যমে। অনলাইন এই আলোচনার কথোপকথন সঞ্চালনের দায়িত্বে ছিলেন সাহিত্যিক স্মরণজিত চক্রবর্তী। একে একে উঠে এল ছোট গল্প থেকে উপন্যাস, বড়দের জন্য লেখা থেকে ছোটদের জন্য সাহিত্য, ভুতের গল্প থেকে গোয়েন্দা উপন্যাস হয়ে থ্রিলার- প্রতি ধারাতেই শীর্ষেন্দুর অপার মুনশিয়ানার কথা।
আলোচনায় উঠে এসেছে শীর্ষেন্দুর একেবারে ছোটবেলার কথা, তাঁর লেখালিখির শুরুর দিনগুলি। ছেলেবেলায় যখন পারিবারিকভাবে পড়ার অভ্যাস তাঁর মধ্যে জারিত হয়েছিল, সেই সময়েই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য শীর্ষেন্দুকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। সেই জমকালো লেখনী থেকে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণের সূত্রপাত। সঙ্গে ছিল রাতে ঘুমের সময় মায়ের গলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা - শীর্ষেন্দুর কথায় এই দুইয়ের মিশেল তাঁর সাহিত্যিক মননের অভিঘাত হিসেবে কাজ করেছিল প্রবলভাবে। সেখান থেকেই ছোট ছোট করে লিখতে শুরু করেন তিনি। সাহিত্যজগতে প্রবেশের দরজা খোলে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশের মাধ্যমে, সেই পথ চলা আজও অবিচল।
কথোপকথনে উঠে আসে শীর্ষেন্দুর উপন্যাস লেখার ধরনের কথা, তাঁর সাহিত্যের নানান চরিত্র কেমন ভাবে সৃষ্টি হয়েছে সেই গল্প। কখনও পুরো উপন্যাস ভেবে লেখা শুরু করেননি তিনি, পরতে পরতে আবিষ্কার করেছেন লেখার মাধ্যমে তাঁর চরিত্রদের। এরকমভাবে ঘটনাক্রম এগিয়ে গিয়েছে নিজের নিয়মে, প্রভাব ফেলেছেন শীর্ষেন্দুর ‘ঠাকুর’ রবীন্দ্রনাথ। আলোচনায় উঠে এল, গোয়েন্দা গল্প আর থ্রিলারের মধ্যে পার্থক্যের কথা, কেন তাঁর গোয়েন্দা একজন পুলিশ, তাও জানালেন। বললেন ভূতের প্রতি তাঁর আকর্ষণের কথা যা তাঁর লেখায় বহুবার উঠে এসেছে। বারে বারে সূক্ষ্মভাবে লেখায় উঠে এসেছে শীর্ষেন্দুর মায়ের কথা, দাদুর কথা, আদতে তাঁর জীবনে যাঁদের এক অনিবার্য প্রভাব রয়েছে। প্রায় প্রতিটি লেখা শেষ হয় মূলত ইতিবাচকভাবে, কারণ তিনি মনে করেন কোনও সাহিত্য যেন পাঠককে জীবন বিমুখ না করে তোলে। স্মরণজিত তুলে আনেন ‘পার্থিব’-র হেমাঙ্গ, ‘কাপুরুষ’-এর বিশুর কথা, যারা উপন্যাসে ঘুরে বেড়ায় এক অসীম নিষ্ক্রিয়তায়, শীর্ষেন্দু যাদের ছায়ায় নিজেকে খুঁজে পান। স্মরণজিত জানান, ‘বন্ধু-অভিভাবকের মতো শীর্ষেন্দু আমার জীবনে প্রভাব ফেলেছেন, তাঁর তৈরি বেশ কিছু চরিত্রকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাই।‘ আলোচনাতে তাই বারে বারে ধরা পড়ে সেই মুগ্ধতার ছবি, আগের প্রজন্মের।
অনুষ্ঠান শুরুতে নাট্যব্যক্তিত্ব, বাচিক শিল্পী সৌমিত্র মিত্রের কথাতেও ধরা পড়ে সেই একই আকর্ষণ-মুগ্ধতার কথা। ‘শীর্ষেন্দুর আটপৌরে অনাড়ম্বর জীবনের ছাপ পড়েছে তাঁর লেখায়, প্রাচুর্যহীন বৈভবহীন জীবন থেকে তৈরি হয়েছে গল্পের চরিত্ররা, যারা সাধারণ মানুষের মতো‘, সৌমিত্রর সঙ্গে কথায় প্রকাশ পায় শীর্ষেন্দুর প্রতিটা ধারার সাহিত্য তাঁকে কী ভাবে আলোড়িত করেছে।
প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন ভারত ও বিশ্বের নানা প্রান্তে সাহিত্য- শিক্ষা- সংস্কৃতির চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে কাজ করে চলেছে, তার মধ্যে, আখর কলকাতার এই দ্বিতীয় অনলাইন প্রয়াস বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য হয়ে থাকল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ দেখেছেন শীর্ষেন্দু, তার পরে এত বছরের সামাজিক-রাজনৈতিক টানাপোড়েন বারে বারে তাঁর লেখাকে প্রভাবিত করেছে, খুলে দিয়েছে নতুন নতুন দিক। এই আলোচনা সেই বিস্তারিত পথকেই এক ঘণ্টার সীমিত সময়ে ধরতে চেয়েছিল, নতুন লেখার অপেক্ষা করতে করতে।