জীবনযুদ্ধ: বারুইপুরের রাস্তায় রুটি-ঘুগনি বিক্রি করছেন মমতা গায়েন। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।
একটা ঘটনা জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে সব কিছু। চাকরি গিয়েছে, ছেড়ে গিয়েছেন কাছের মানুষজন। সব হারিয়েও অবশ্য লড়াই ছাড়েননি বারুইপুরের অ্যাসিড আক্রান্ত মমতা গায়েন। বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হাতে টানা ছোট গাড়িতে চা-ঘুগনি বিক্রি করছেন বছর পঞ্চাশের মহিলা। তৈরি করছেন রুটিও। রোজ সেই গাড়ি ঠেলে পাড়ার মোড়ে গিয়ে বসেন তিনি। সারা সন্ধে রুটি, ঘুগনি, চা বেচে বাড়ি ফেরেন রাতে।
বারুইপুরের উকিলপাড়া এলাকার বাসিন্দা মমতা। এক সময়ে কলকাতার একটি বেসরকারি সংস্থায় রিসেপশনিস্টের কাজ করতেন। সংসার সামলে রোজ সকালে বারুইপুর থেকে ট্রেনে বালিগঞ্জ যেতেন। সেখান থেকে কর্মস্থলে। কাজ সেরে আবার ট্রেনে করে ফিরতেন। ২০১০ সালে এক দিন বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনে অ্যাসিড হামলা হয় মমতার উপরে। প্রৌঢ়া জানান, রোজকার মতো সে দিনও ফেরার পথে সন্ধ্যাবেলা বালিগঞ্জ থেকে ট্রেন ধরেন। ট্রেন ছাড়ার মুখে কিছুটা দৌড়েই মহিলা কামরায় ওঠেন তিনি। তখনই অ্যাসিড ছুড়তে ছুড়তে ওই কামরা থেকে নেমে যাচ্ছিল কয়েক জন দুষ্কৃতী। মমতার মুখে-শরীরে এসে লাগে অ্যাসিড। মমতার পাশাপাশি আরও ১১ জন যাত্রী জখম হন সেই ঘটনায়। কিছুটা এগিয়ে ঢাকুরিয়া রেল বস্তির কাছে ট্রেনের গতি কমতেই লাফিয়ে নেমে পড়েন তাঁরা। বস্তির বাসিন্দারাই তাঁদের প্রাথমিক শুশ্রূষা করেন। পরে রেল পুলিশ এসে মমতাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা চলে প্রৌঢ়ার। তবে একটা চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ওই ঘটনার পরে চাকরি চলে যায় মমতার। ছেড়ে চলে যান স্বামীও। মায়ের সঙ্গে থাকতেন প্রৌঢ়া। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ফেরার কিছু দিনের মধ্যে মৃত্যু হয় বৃদ্ধা মায়েরও। আরও একা হয়ে পড়েন মমতা। নতুন কাজ জোগাড়ের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় মুখে-শরীরে ক্ষত চিহ্ন। কিছু দিন আয়ার কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, সেখানেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর শরীরের পোড়া দাগ। মমতা জানান, লোকজন তাঁকে এড়িয়ে চলতেন। সে ভাবে কাজ মিলত না। ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নেন প্রৌঢ়া। কার্যত ঘরবন্দি হয়ে পড়েন। সেই সময়ে দাদার পরিবারের তরফে এক বেলা খাবার মিলত। তা দিয়েই কোনও রকমে দিন গুজরান করতেন তিনি।
পরে অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা বারুইপুরের একটি সংগঠনের হাত ধরে ঘর থেকে বেরোন মমতা। অ্যাসিড আক্রান্ত আরও মহিলাদের সঙ্গে মিলে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস ফেরে। শেষ পর্যন্ত বছরখানেক আগে নিজেই কিছু করার ইচ্ছা থেকে তৈরি করে ফেলেন একটি হাতে টানা গাড়ি। সেই গাড়ি নিয়েই রোজ বিকেলে বাড়ির কাছে পাড়ার মোড়ে বসেন মমতা। চা, বিস্কুট, ঘুগনি বিক্রি করেন। রুটিও বানান। পাড়ার অনেকেই রাতে খাবারের জন্য কিনে নিয়ে যান মমতার রুটি। চা-ঘুগনি খেতেও ভিড় করেন অনেকে। মমতা জানান, দু’-তিনশো টাকার বিক্রি হয় রোজ। তাতেই তাঁর একার সংসার চলে যায়।
মমতার কথায়, “এক সময়ে ভেবেছিলাম, সব শেষ। সেখান থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। নিজের ব্যবস্থা নিজেই করে নিতে পারছি।” অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা ওই সংগঠনের তরফে বিমান দত্ত বলেন, “মমতার এই লড়াই আরও অনেক অ্যাসিড আক্রান্তকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরার সাহস জোগাবে। আমরা ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করছি ব্যবসা আরও বাড়াতে। ইতিমধ্যেই মমতার ঠেলাগাড়িতে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগামী দিনে যাতে উনি রুটি-তরকারি হোম ডেলিভারি করতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও করা হবে।”