কুয়াশা আর দূষণে ঢেকেছে ট্রেন। সোমবার, বেলুড় স্টেশনে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
১৯১১ সালে কলকাতার কাছ থেকে রাজধানীর তকমা কেড়ে নিয়েছিল দিল্লি। এ বার কি প্রতিশোধ হিসেবে দিল্লির কাছ থেকে ‘দূষণ রাজধানী’র তকমা কাড়তে চায় কলকাতা?
সম্প্রতি বায়ুদূষণের তথ্য বিশ্লেষণ করে এমনই প্রশ্ন তুলেছেন শহরের পরিবেশকর্মীদের একাংশ। তাঁরা জানাচ্ছেন, বায়ুদূষণের নিরিখে এত দিন দিল্লিই ছিল বড় শহরগুলির মধ্যে প্রথম। কিন্তু চলতি বছরের শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে, প্রায় রোজই দিল্লিকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছে কলকাতা। মাঝেমধ্যেই টপকে যাচ্ছে। পরিস্থিতি এমনই যে, কলকাতার রাস্তায় শ্বাসকষ্ট হওয়া নিয়ে এজলাসে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন জাতীয় পরিবেশ আদালতের বিচারপতি এস পি ওয়াংদি-ও।
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ইদানীং কলকাতার হাওয়ায় বিষের মাত্রা মাপছে না। যন্ত্র সারানোর দোহাই দিয়ে রাজ্য সরকারও বহু জায়গায় মাপা বন্ধ রেখেছে। হাতেগোনা কয়েকটি জায়গায় পরিমাপ করে ৩০ ঘণ্টা অন্তর সেই দূষণের সূচক প্রকাশ করে তারা। মার্কিন দূতাবাস অবশ্য তাদের দফতর সংলগ্ন এলাকায় নিয়মিত দূষণ মেপে প্রতি ঘণ্টায় সূচক প্রকাশ করে। সেই সূচকে দেখা যাচ্ছে, শনি ও রবিবার দিল্লিকে বহু পিছনে ফেলে দূষণে প্রথম হয়েছে কলকাতা। সোমবার সকাল ছ’টা থেকে দূষণের শিরোপা নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই শুরু হয়েছিল দিল্লি ও কলকাতার। বেলা তিনটেয় এসে দিল্লিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় কলকাতা।
কিন্তু দূষণ এত বাড়ছে কেন?
এই দূষণের পিছনে গাড়ি, নির্মাণস্থল, ভাগা়ড় থেকে উড়ে আসা ধোঁয়া-ধুলোই মূলত দায়ী বলে পরিবেশবিদদের দাবি। তাঁদের অভিযোগ, এই সব উৎসে লাগাম টানতে ব্যর্থ রাজ্য। তার ফলেই বিষবায়ু গিলতে হচ্ছে আমজনতাকে। বৃষ্টি হলে সেই জলে হাওয়ায় ভাসমান ধূলিকণা ধুয়ে যায়। কিন্তু শীতকালে বৃষ্টি না হওয়ায় বাতাস প্রাকৃতিক উপায়ে পরিষ্কার হচ্ছে না। তাই সমস্যা আরও বেশি করে চোখে পড়ছে। কোনও নিয়ন্ত্রণ না থাকাতেই ক্রমশ কলকাতা ‘দূষণ রাজধানী’ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক আবহবিজ্ঞানী বলছেন, ‘‘কুয়াশার কারণে ধূলিকণা বাতাসের নীচের স্তরে আটকে থাকছে। ধোঁয়া, ধুলো মিশে কুয়াশা গাঢ় হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে ধোঁয়াশা।’’
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ-এর অধ্যাপক তড়িৎ রায়চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘আগেও দূষণ ছিল। কিন্তু সে ভাবে মাপা হত না। যত দিন যাচ্ছে, গাড়ি ও নির্মাণকাজের সংখ্যা বাড়ছে। পুরনো গাড়িও বাতিল হচ্ছে না। ফলে দূষণও বাড়ছে।’’ তাঁর মতে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি, বাড়ি-সহ অনেক কিছুই পরিবেশোপযোগী করে তুলতে হবে। কিন্তু এখানে তা না হওয়ায় কলকাতা দূষণের রাজধানী হয়ে উঠছে।
কলকাতার এমন শিরোপায় অবশ্য খুশি নন রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্তারা। মার্কিন দূতাবাসের তথ্য নিয়েও আপত্তি রয়েছে তাঁদের। এক পর্ষদকর্তার বক্তব্য, মার্কিন দূতাবাসের তথ্য সার্বিক কলকাতার চিত্র নয়। তাই ওই তথ্য বিভ্রান্তিকর। কিন্তু পর্ষদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে শেষ শনিবারের হিসেব মিলছে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে, শহরের চার প্রান্তে বায়ুদূষণের মাত্রা অতি খারাপ বা বিপজ্জনক গোত্রে রয়েছে। অর্থাৎ, মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে পর্ষদের তথ্যে সংখ্যার ফারাক থাকতে পারে। কিন্তু সার্বিক চিত্র একই।
পরিবেশকর্মীদের একাংশের অভিযোগ, রাজ্য আসলে সত্যিটা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে চাইছে। কলকাতার বায়ুদূষণ সংক্রান্ত মামলায় আদালতেও সেটা প্রমাণ হয়েছে। ওই মামলার আবেদনকারী, পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘আদালতের নির্দেশ কিছুই কার্যকর করেনি রাজ্য। মামলা একই তিমিরে রয়ে গিয়েছে। কলকাতায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে সিএনজি চালুতেও গা-ছাড়া মনোভাব রাজ্যের।’’
কিছু করা হয়নি, এ কথা মানতে নারাজ পরিবেশ, পরিবহণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্তারা। তাঁদের মতে, বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে। জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা (নিরি)-কে দিয়ে দূষণের উৎস সন্ধান চলছে। দূষণে রাশ টানা নিশ্চয়ই যাবে। যদিও এই রাশ টানায় কতটা কর্তাদের হাত থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে পরিবেশ দফতরের অন্দরেই। তাদেরই এক অফিসার বলছেন, এই সব প্রকল্পের কথা বলতে বলতেই এপ্রিল মাস চলে আসবে। বৃষ্টিও শুরু হবে। তাতেই এক ঝটকায় দূষণ কমবে। ‘‘কলকাতায় যদি এত বৃষ্টি না হত, তবে ঠেলা বুঝতেন কর্তারা,’’ মন্তব্য ওই অফিসারের।