দিল্লিকে ঝাপসা দেখেই ভাবনা শুরু কলকাতায়

বাংলা ভাবে আগে, তার পরে বাকিরা— এটা বুঝি আর বলা যাচ্ছে না! এ যাত্রা বরং দিল্লিকে দেখে টনক নড়েছে কলকাতার! ফি বছর অক্টোবর মাস পেরোলেই কলকাতার বাতাসে দূষণের মাত্রা তরতরিয়ে বাড়তে থাকে। কুয়াশা ও বাতাসের ভাসমান কণার মিশেলে ধোঁয়াশাও তৈরি হয়।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৯
Share:

বাংলা ভাবে আগে, তার পরে বাকিরা— এটা বুঝি আর বলা যাচ্ছে না! এ যাত্রা বরং দিল্লিকে দেখে টনক নড়েছে কলকাতার!

Advertisement

ফি বছর অক্টোবর মাস পেরোলেই কলকাতার বাতাসে দূষণের মাত্রা তরতরিয়ে বাড়তে থাকে। কুয়াশা ও বাতাসের ভাসমান কণার মিশেলে ধোঁয়াশাও তৈরি হয়। মহানগরের বাতাসে বিষবৃদ্ধির কথা উঠে এসেছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টেও। জাতীয় পরিবেশ আদালতে হলফনামা দিয়ে দূষণের কথা স্বীকার করতে হয়েছে রাজ্য পরিবেশ দফতরকে। কিন্তু তার পরেও দূষণ ঠেকাতে কোনও তৎপরতা দেখা যায়নি বলেই পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ।

দিল্লিতে ২০০০ সিসি-র উপরে ডিজেল গাড়ি নিষিদ্ধ করার পরে যান দূষণ কিছুটা কমেছিল। সে নিষেধাজ্ঞা পরে উঠে যায়। অন্যান্য কারণেও শীতের গোড়াতেই দূষিত ভারী বাতাসের চাদর মুড়ে ফেলেছে রাজধানীকে। বিপর্যস্ত জীবনযাত্রা।

Advertisement

কলকাতার বাতাস মাত্রাছাড়া যান-দূষণের জন্য এমনিতেই ভারী। শহর থেকে ডিজেল-চালিত এবং ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি না সরানোয় দিনকে দিন বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়ছে। একটি জাতীয় পরিবেশ সংস্থার সমীক্ষা বলছে, কলকাতায় চলাচলকারী ৯৯% বাণিজ্যিক গাড়িই ডিজেলে চলে। সরকারি গাড়ি, বিশেষ করে পুলিশ ভ্যান, পুরসভার জঞ্জাল নেওয়ার লরির মেয়াদ ১৫ বছর পেরিয়ে গিয়েছে অনেক দিন। প্রতিদিন সেগুলি নাইট্রোজেন ও সালফারের অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ছড়িয়ে চলেছে বাতাসে।

এর সঙ্গে দিল্লির মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র বা চাষের জমিতে খড়-আগাছা পোড়ানোর ধোঁয়া কিংবা আনুসঙ্গিক অন্য বিপদগুলি যদি যোগ হয়, তবে কলকাতার দশা কী হবে তা নিয়ে পরিবেশ কর্মীরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন।

পরিবেশ দফতরের খবর, কয়েক দিনের বৃষ্টি কালীপুজোর দূষণ আপাতত ধুয়ে দিলেও দিল্লিকে নাকানিচোবানি খেতে দেখে নড়েচড়ে বসেছেন এ রাজ্যের কর্তারা। কী ভাবে বাতাসের দূষণ কমানো যায়, তা নিয়ে দফতর ও রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্তাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন পরিবেশমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায়। সেই আলোচনার পরে দূষণ ঠেকানোর পরিকল্পনাও তৈরি করতে বসেছেন তাঁরা। দফতরের কর্তারা অবশ্য বলছেন, বছর-বছর মহানগরের বাতাসে দূষণ বাড়ছে। কিন্তু শহরের কোন কোন উৎস থেকে কতটা দূষণ হয়, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য রাজ্যের হাতে নেই। তাই দূষণ ঠেকানোর পরিকল্পনা করলেও তা পুরোপুরি কাজে আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকে যাবে। যে কারণে দূষণের উৎস নিয়ে সমীক্ষার কথাও তাঁরা ভেবেছেন।

রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রের খবর, ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নিরি)-কে দিয়ে এই সমীক্ষা করানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সমীক্ষা শেষ করতে অন্তত দেড় বছর সময় লাগবে। পর্ষদের এক শীর্ষকর্তার অবশ্য দাবি, ‘‘এই সমীক্ষার সিদ্ধান্ত দিল্লির দূষণ সমস্যা সামনে আসার আগেই নেওয়া হয়েছিল।’’

পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, রাতের যে সব মালবাহী গাড়ি শহরে ঢোকে সেগুলির অধিকাংশেরই দূষণ ছাড়পত্র নেই। শহরের গাড়িগুলিরও পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে কি না এবং নিয়মিত তা পরীক্ষা করা হয় কি না— এ সব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

শহরের আরও দু’টি বড় বিপদের দিকেও নজর দেওয়ার কথা বলছেন পরিবেশকর্মীরা। এক, জঞ্জাল ও প্লাস্টিক পোড়ানোর চল। দুই, নির্মাণকাজের দূষণ। বাড়িঘর রাস্তা তৈরি ও মেরামতির কাজ থেকেও থেকেও বায়ু কম দূষিত হয় না। এক পরিবেশকর্মীর কথায়, ‘‘রাস্তা তৈরি বা সারানোর জন্য সরকারি ঠিকাদাররাই খোলা জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে পিচ গলান। তা থেকে ঘন কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আশপাশের এলাকা বি‌ষাক্ত করে তোলে।’’ তাঁর দাবি, একই ভাবে রাস্তার উপরে ফেলে রাখা নির্মাণসামগ্রী কিংবা নির্মাণস্থল থেকে সিমেন্ট-বালি-ইটের গুঁড়ো বাতাসে মেশে। নাগরিকদের স্বাস্থ্যের পক্ষে সেগুলিও সমান ক্ষতিকর। দিল্লি বা কলকাতা, দেশের যে কোনও প্রান্তেই শহর যখন আড়ে-বহরে বাড়ে, তখন এই বিপদও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।

পরিবেশকর্মীরা তাই মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করার জন্য সমীক্ষা অবশ্যই করানো দরকার। কিন্তু একই সঙ্গে এখনই প্রয়োগ করা যায়, এমন কিছু ব্যবস্থার কথাও ভাবা জরুরি। এই প্রসঙ্গে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় কয়েকটি দাওয়াইয়ের কথা বললেন, যা এখনই প্রয়োগ করতে কোনও বাধা নেই। বিশ্বজিৎবাবুর পরামর্শ:
• দূষণ ছাড়পত্র (পিইউসি) নিয়ে কড়াকড়ি করতে হবে। পিইউসি ছাড়া গাড়ি দেখলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে, জরিমানাও বাড়াতে হবে।
• শহর থেকে মালগ়াড়ির টার্মিনাল সরাতে পারলে শহরে ট্রাকের সংখ্যা কমবে।
• রাস্তা তৈরির সময় প্রকাশ্যে পিচ গলানো যাবে না।
• জঞ্জাল পোড়ানোয় রাশ টানতে হবে।
• কয়লার উনুন কমিয়ে গ্যাসের সংযোগ বাড়াতে হবে।
• দেখতে হবে, যে কোনও নির্মাণ কাজে যেন পরিবেশ বিধি মানা হয়।

এই প্রস্তাবগুলি বিশ্বজিৎবাবু কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকেও পাঠাবেন। এই পদক্ষেপগুলি করা হলে তা বাতাসের দূষণ কমাতে কাজে আসবে বলে মনে করছেন দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কর্তাদের একাংশ। কেউ আবার প্রশ্ন তুলছেন, দিল্লির বিপদ দেখে কলকাতায় আতঙ্ক ছড়ানোর দরকার কী? কলকাতার সকাল তো এখনও দিল্লির মতো ঝাপসা হয়ে পড়েনি! এর জবাবে পরিবেশকর্মীরা বলছেন, এটা ঘটনা যে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি ততটা কঠিন মনে হচ্ছে না কলকাতায়। কিন্তু এটা একেবারেই সাময়িক। এক পরিবেশ কর্মীর ব্যাখ্যা, এ বারও কালীপুজোর সময়ে কলকাতার বাতাসে দূষণ যথেষ্ট বেড়েছিল। কিন্তু নিম্নচাপের জেরে ক’দিন ধরে দফায় দফায় বৃষ্টি হওয়ায় বৃষ্টি হওয়ায় দূষণ এক ধাক্কায় অনেকটাই কমে গিয়েছে। কলকাতার আকাশ এখন পরিষ্কার। জলীয় বাষ্পের পরিমাণও কমে গিয়েছে। তাই এ দিন শহরের বেশির ভাগ জায়গাতেই বাতাসে ভাসমান কণার পরিমাণ স্বাভাবিক বলেই পর্ষদ সূত্রে জানা গিয়েছে।

কিন্তু এ স্বস্তি আর ক’দিনের!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement