সাউথ সিটি কলেজের সামনে লম্বা লাইন নিয়ন্ত্রণে ইউনিয়নের নেতা-সদস্যেরা।সোমবার। নিজস্ব চিত্র
কোথাও কলেজের মূল ফটকের সামনেই দাঁড়িয়ে পুলিশের গাড়ি। আবার কোথাও কলেজের কর্মী প্রতিটি নথি যাচাই করে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছেন। এই বজ্র আঁটুনির মধ্যে তবু শোনা গেল ফিসফিস, ‘দু’দিন পরে আয় দেখা যাবে!’
কলেজে ভর্তির নামে বহিরাগতদের টাকা নেওয়া, দালাল-চক্রের দাপটের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উঠছে। সেই খবর প্রকাশ্যে আসতেই সক্রিয় হয়েছে পুলিশ। এক দিকে চলছে গ্রেফতার। অন্য দিকে ভর্তির জন্য অতিরিক্ত টাকা না দেওয়ার জন্য ছড়ানো হচ্ছে সতর্কবার্তা। সোমবার স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেরোন কলেজ পরিদর্শনে। শহরের একাধিক কলেজ ঘুরে দেখেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। কিন্তু তার মধ্যেও কান পাতলে শোনা যায় ফিসফিস— ‘এ সব আর ক’দিন!’
এ দিন মণীন্দ্রচন্দ্র কলেজের সামনে সার দেওয়া পুলিশের গাড়ি। লালবাজারের বিভিন্ন স্তরের কর্তারা নজরদারির দায়িত্বে। বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। জয়পুরিয়া কলেজে সেই নজরদারি আরও বেশি। তারই মধ্যে এ দিন সকালে এক তরুণী অভিযোগ তোলেন, কাউন্সেলিংয়ে ঢুকতে দেওয়ার জন্য তাঁর থেকে অতিরিক্ত টাকা দাবি করা হয়েছে। তা নিয়ে পরিস্থিতি জটিল হয়। আরও জোরদার হয় পুলিশি পাহারা। ভর্তির জন্য যাওয়া ছেলেমেয়েদের প্রতিটি নথি যাচাই করে তবেই ঢোকার অনুমতি দেন কলেজের দুই কর্মী।
আরও পড়ুন: ভর্তিতে টাকার খেলা মানতেই নারাজ পার্থ
সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অবশ্য ভর্তি হতে আসা আবেদনকারীদের নথি যাচাই করছিলেন এক ‘ইউনিয়নের দিদি’। পাশে দাঁড়িয়ে কলেজের নিরাপত্তাকর্মী। কেউ এসে জানান কাউন্সেলিংয়ে পৌঁছতে পারেননি, কারও বা তালিকায় নাম ওঠেনি। কী করণীয়, তাঁরা জানতে চাইছেন দিদির কাছে। দিদি জোর গলায় জানালেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র কলেজ এটা নয়। অন্য কোথাও যান।’’ কয়েক মুহূর্তেই বদলাল সুর। সামনে দাঁড়ানো এক আবেদনকারীর কাছে নিচু গলায় পৌঁছল বার্তা, ‘দু’দিন পরে আয়, দেখা যাবে!’ যদিও ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় কলেজ পরিদর্শনে গেলে নিরাপত্তার ছবি বদলে যায়। ভিড়ে মিলিয়ে যান ইউনিয়নের দিদিও। মূল ফটক ঘিরে তখন শুধুই নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশ। অধ্যক্ষকে যোগাযোগের চেষ্টা হলে অবশ্য ফোনে পাওয়া যায়নি।
সাউথ সিটি কলেজের ছবিটাও অনেকটা এ রকমই। কলেজের সামনে লম্বা লাইন। লাগোয়া চায়ের দোকানেও ভিড়। স্থানীয়দের একাংশের বক্তব্য, তাঁরা ওই কলেজেরই ছাত্র সংসদের সদস্য। কলেজের সামনে দেখা যায়নি পুলিশের তরফে কোনও প্রচার, হোর্ডিং এমনকি, দেখা মেলেনি পুলিশেরও। ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের ভিড় থাকলেও, ইউনিয়ন নেতা-সদস্যরাই সেই লাইন নিয়ন্ত্রণ করছেন। হেরম্বচন্দ্র কলেজের (সাউথ সিটির দিবা বিভাগ) অধ্যক্ষা নবনীতা চক্রবর্তীর অবশ্য দাবি, ‘‘ভর্তি প্রক্রিয়া চলে অনলাইনে। বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। সে সংক্রান্ত নোটিসও রয়েছে।’’
মণীন্দ্র, জয়পুরিয়ার মতো দক্ষিণের দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ কলেজে ছিল কড়া পুলিশি প্রহরা। কলেজে ঢোকার মুখেই পুলিশ হোর্ডিং টাঙিয়ে দিয়েছে। বক্তব্য, ভর্তির জন্য কেউ টাকা চাইলে তা যেন পুলিশকে নির্ভয়ে জানানো হয়। ঝোলানো হোর্ডিংয়েও লেখা তেমন কথাই। কলেজের উল্টো দিকে একটি দোকানের বসে কিছুটা আড়াল থেকে সে দিকে নজর রাখতে দেখা গেল রাজ্যের পুরমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকে। যদিও মন্ত্রীর বক্তব্য, ‘‘ব্যক্তিগত কাজে এসেছি।’’ তবে অনেকেরই ধারণা, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরে টাকা নিয়ে কলেজে ভর্তি বন্ধ হয়েছে কি না, তা দেখতেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী। স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের অনেকেই জানান, গত কয়েক দিন ধরেই কলেজের ইউনিয়ন ঘর বন্ধ। ছাত্র সংসদের নেতাদের দেখা যাচ্ছে না। কলেজের অধ্যক্ষ সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘২০১১ সাল থেকেই অনলাইন পদ্ধতি চালু হয়েছে। এখন প্রায় পুরো ভর্তি প্রক্রিয়াই হচ্ছে অনলাইনে।’’ বিজয়গড় এবং কে কে দাস কলেজেও ব্যবস্থা ছিল আঁটোসাঁটো। কে কে দাস কলেজের অধ্যক্ষ রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। টাকা দিয়ে ভর্তি না করার জন্য অনেক দিন আগে থেকেই প্রচার চালানো হচ্ছে।’’