সুদীপা তখন যেমন।
আমার জন্ম কলকাতার আনন্দ পালিত রোডে। এখান থেকে লিনটন স্ট্রিট যখন চলে আসি, তখন আমার বয়স খুবই কম। সেখানে খুব ছোট ছোট ঘরে আমার বেড়ে ওঠা। তখন আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য সে ভাবে না থাকলেও, বেড়ে ওঠাটা খুবই আনন্দের ছিল। লিনটন স্ট্রিট জায়গাটা পার্ক সার্কাস এবং এন্টালির আশেপাশে। বাড়ির সামনেই একটা চ্যাপেল ছিল। প্রত্যেক রোববার করে ওখানে মাস হতো। সে কারণেই আমি ছোটবেলা থেকেই বড়দিন, ঈদ-এর মতো অনেক ধর্মের উৎসব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছি। বাড়িতে ছোট থেকে নাচ-গান-বাজনা, নাটকের পরিবেশ ছিল। সে জন্য বিশেষ করে রোববার খুব মজার হয়ে উঠত। তখনও কিন্তু কলকাতা শহরকে সে ভাবে চিনে উঠতে পারিনি। আমি যখন ক্লাস ফাইভ-এ পড়ি, কাঁকুলিয়া রোডে আসি। এখানে পাঁচ বছর ছিলাম। এই সময় থেকে কলকাতাকে একটু একটু করে চিনতে থাকি। এর পর লেক গার্ডেন্সে আমাদের নিজেদের বাড়ি হল। তখন থেকে আমার পাখা ওড়ে, নানান জায়গায় চড়ে বেড়াতে থাকি এবং কলকাতা শহরকে চিনতে শুরু করি। তখন আমি লেক গার্লসে পড়ি। ১২-এ ভর্তি হই সাউথ সিটি কলেজ। এখানে থেকেই গ্র্যাজুয়েশন করি। আসলে ওই নাইন থেকেই আমার পাখনা গজায়। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই একলা চলাফেরা করি। হেঁটে হেঁটেই স্কুলে যেতাম। তার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল। ১১-১২ ক্লাসে প্রচণ্ড লায়েক হই। আর কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে তো কথাই নেই। রাজনৈতিক ভাবেও খুব সচেতন ছিলাম, ফলে স্ট্রিট থিয়েটার করা, কর্নার প্লে করা — সেই দৌলতে উত্তর দক্ষিণ সমস্ত কলকাতা ঘোরা। তখন পকেট মানির জন্য ডোর টু ডোর সেল করতাম। সাবান এই সব বিক্রি করা। ফলে মে মাসের দুপুরে হাঁটার অভ্যেসও ছিল। তখন একটা অ্যাড এজেন্সিতে খুব কম পয়সায় কাজ করি। ওরা বলত, মাস কমিউনিকেশন। আসলে ফুটপাতের প্রোডাক্ট নিয়ে চিৎকার করে এখন যেমন হকাররা বিক্রি করে, তেমনটা। ফলে ধর্মতলা থেকে অফিস পাড়াটাও আমার কাজের সূত্রে খুব ভাল করে চেনা। আমি বরাবরই মানুষের সঙ্গে সহজে মিশে যেতে পারি, সে কারণে আমার এ কাজে কোনও অসুবিধে হতো না। সকাল ১১ টা পর্যন্ত কলেজ থাকত। ৪-৪.৩০ পর্যন্ত এ কাজ করতাম। তার পর সেলস রিপোর্ট জমা দিয়ে চলে যেতাম থিয়েটার করতে। কায়ানট বলে একটা দলে আমি প্রথম থিয়েটার করা শুরু করি। তা ছাড়া ছোটবেলা থেকেই পাড়ায় নানা রকম অনুষ্ঠান করতাম। তবে আমি মূলত নাচেরই ছাত্রী। আমি কত্থকের তালিম নিই শিল্পী চিত্রেশ দাশ-এর কাছে। মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল আমি নাচটাই ভাল করে করি। প্রথম দিকে পাড়ায় প্রচুর ফাংশন করতাম, তার পর থিয়েটারের দিকে ঝুঁকে গেলাম।
আরও পড়ুন, অ্যাপের হাত ধরে ‘বন্ধু’ হবে পুলিশ
আমার মধ্যে আমি যা নই সেটা হওয়ার ইচ্ছে ছিল বরাবর। জীবনে প্রথম অভিনয় করি একটা ছেলের চরিত্রে। শৈলেশ গুহ নিয়োগী’র ‘ফাঁস’ বলে একটা থিয়েটার করে খুব মজা পেয়েছিলাম। ছেলেটির ‘স’-এর দোষ ছিল। ‘বাবা দসটা টাকা দেবে?’ এমন একটা চরিত্র। সেই থেকে কায়ানট। অঞ্জনদা’ই মূলত আমার মধ্যে থিয়েটারটা চাগিয়ে দিয়েছিলেন। উঁনিই মেঘনাথ দা’র কাছে নিয়ে যান সায়কের জন্য।
তখন কায়ানট-এ সীমা মুখোপাধ্যায়, দোলন (রায়) আমরা এক সঙ্গে অভিনয় করতাম। তখন দোলনও খুব স্ট্রাগল করছে। বিভিন্ন অফিস ক্লাবে অভিনয় করত। সে সময় একটা শো করে যে টাকাটা পেতাম, সেটাই আমাদের কাছে অনেক ছিল। এই ভাবেই গেল আমার কলেজ জীবন। ৮৯ সালে আমার বিয়ে হল। আমার শ্বশুরবাড়ি ছিল যাদবপুরে। সেটাও শহরের বিরাট একটা প্রাণচঞ্চল জায়গা। একদম ৮বি বাসস্ট্যান্ডের মোড়।
টেলিভিশন শো-এ সুদীপা।
আমার আসল পদবি ভট্টাচার্য। কিন্তু আমার প্রথম হাজব্যান্ডের নাম ছিল শৈবাল বসু, সেই থেকেই এই পদবি। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। শৈবালের সঙ্গে আমার প্রেম কাজ (ডোর টু ডোর সেল) করতে করতেই। আমাদের একটা খুব কমন ইন্টারেস্ট ছিল, সিনেমা। তখন তো আর ডেলিগেট কার্ড পেতাম না। ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এর সময় রাত সাড়ে তিনটে’র সময় প্রিয়া সিনেমা হলের সামনে চলে যেতাম। সকাল ১০টায় কাউন্টার খুলত। লাইন পড়ত বিশাল। রাত জেগে অত কষ্ট করে লাইন দেওয়ার পরে, হাতে টিকিট পাওয়ার পর সে যে কী উন্মাদনা! যেন কিছু একটা হল।
শৈবালের সঙ্গে বিয়ের পর তাজ বেঙ্গলে জয়েন করলাম। সেখানে চার বছর ছিলাম। আবার তাজ বেঙ্গল ছেড়ে থিয়েটারে যাওয়া। সে সময় অঞ্জন দত্তের থিয়েটার দল ওপেন থিয়েটারে অভিনয় করেছি। তার পর সায়ক-এর থিয়েটারে জয়েন করলাম। এই সময়ের আগে পর্যন্ত কলকাতাকে অন্য ভাবে চিনেছিলাম। এর পর থেকে আমার বিভিন্ন হলে গিয়ে থিয়েটার করা, বিভিন্ন মানুষজনকে জানা শুরু।
কলকাতাকে নিয়ে আমার বড় বেশি একচোখামি আছে। আমি ভীষণ কলকাতা-প্রেমী। তবে কিছুটা ব্যক্তিগত কারণেই হায়দরাবাদে থাকতে হয়েছিল প্রায় চার বছর, মুম্বইতে চার বছর। তখন কলকাতা কী, আমি বুঝেছিলাম। আমি তো পুরোপুরি থিয়েটার-সিনেমা এ সবের সঙ্গে যুক্ত মানুষ। কিন্তু ওখানে এমনও হত, তিন দিন হয়ে যেত কোনও মানুষের সঙ্গে কথা হত না। ওখানে থাকলে আর্থিক দিক থেকে হয়তো আমার লাভ হত, কিন্তু আমি থাকতে পারলাম না। তা ছাড়া ওখানকার জীবনযাত্রা যদিও বা মানিয়ে নিতে পারি, কলকাতার কালচারটা ছাড়া থাকা অসম্ভব। কলকাতাই আমার সব জানে। আমার যত বদমাইশি, আমার নেশা করা ... আমার এটা বলতে অসুবিধে নেই, আমি এক সময় খুবই গাঁজা খেতাম। কলকাতায় কোথায় কোথায় গাঁজার ঠেক, সব আমি জানি। তবে হেরোইন ও সব কখনও খাইনি, ট্যাবলেটও খেয়েছি। আজকে আমি এই সব কথা খুব সহজেই বলতে পারছি, এ সব থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি বলে।
কলকাতা এমন একটা শহর যে তুমি চাইলে সব পাবে। অন্য ধর্মের কালচারের খোঁজ পাবে, বইয়ের লাইব্রেরি বলো, সিনেমা, নাচ, গান থিয়েটার, রাজনীতি, তর্ক, আড্ডা — কিছুই বলার অপেক্ষা রাখে না। আসলে প্রবল ভাবে বাঁচার মধ্যে সব থাকে। তবে এই মুহূর্তের ইয়ং এজের ছেলে-মেয়েদের জীবনযাত্রা নিয়ে কিছু বলতে পারব না। আমি যা দেখি, বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা সব স্টুডিওতে ঢোকে, সারা দিন সিরিয়ালের শুটিং করে, আবার চলে আসে। কলকাতার মধ্যে যে রসদগুলো আছে, তাকে খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছেটাই এদের মধ্যে খুব কম। তারা অদ্ভুত ভাবে বাংলা বলে, অদ্ভুত একটা কালচারে বাঁচে। কেনই বা গণেশ পুজো, সন্তোষী মায়ের পুজো করে, জানে না। নন বেঙ্গলিরা করে বলে ওরাও করে। খুব অদ্ভুত লাগে। সে জন্যই বোধ হয় ওদের এক দিন শুটিং না থাকলে ডিপ্রেশন লাগে। ওরা সত্যিই জানে না অবসর সময়টা নিয়ে ওরা কী করবে। সত্যি কথা বলতে আমাদের তো হাতে ধরে কেউ কিছু শিখিয়ে দেয়নি। আমরা নতুন কিছু শেখা কিংবা ভাল লাগার জায়গাগুলো স্বেচ্ছায় খুঁজে নিয়েছিলাম। যেমন আমি লিটল ম্যাগাজিনে লিখব, গ্রুপ থিয়েটার করব। আমার ইচ্ছে করলে শুধু রোজগারের জন্যই কোনও পেশায় যেতে পারতাম। আমার মনে হয়েছিল টাকা রোজগারের জন্য সময়টা পরেও থাকবে। কিন্তু এই বয়সের এনার্জি, আবেগটা চলে গেলে আর কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন, প্রবীণদের বিপদে ভরসা প্রযুক্তিও
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমার খুব ভাল বন্ধু সুপ্রিয় দত্ত। এখন খুব বাংলা সিরিয়াল করে। আমরা দু’জন দু’জনকে বরাবরই ‘কমরেড’ বলে ডাকি। ও একদিন রাত সাড়ে এগারোটায় ফোন করে বলে কমরেড, তুমি কী করছ? তখন আমি রাত্রিবেলা মদ্যপান করছি। আমি ওর এক বন্ধুর কথা শুনেছিলাম। ছেলেটির নাম অশোক পাত্র। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়ে ওর পাঁচতলা বাড়ি। ভালবেসে বিয়ে করেছিল একজন মুসলমান কাগজ কুড়ানিকে। যার চার-পাঁচ জন বাচ্চা আছে। ওদের নিয়ে ও ডানলপের বস্তিতে থাকত। অত রাতেই চিকেন তন্দুর এ সব নিয়ে আমরা ওদের বাড়িতে যাই। তখন একটু একটু করে আমি টেলিভিশনে পরিচিত হচ্ছি। ওই বস্তিতে ছোট্ট একটা ঘরে ওর বউ রান্না করছিল। ওদের ঘরের একদম গা দিয়ে রেললাইন। আমরা যখন রেললাইনের ধারে বসলাম নিজেদের পানীয় নিয়ে, তখন রাত্রি প্রায় দেড়টা হবে। পুরো ‘টিনের তলোয়ার’ নাটকটা পড়লাম। মহিলাদের অংশটা আমি পড়লাম। ছেলেদের চরিত্রগুলো পুরোটা সুপ্রিয় এবং অশোক পাত্র পড়ল। এভাবেই দেখলাম ভোর হয়ে গেল! সূর্য ওঠা দেখলাম। এটাই কলকাতা। এই কলকাতা যেমন দেখেছি, তেমনই ফাইভ স্টার, কর্পোরেট মিটিংস এই কলকাতাই আমাকে দিয়েছে। এত বৈচিত্র! কলকাতায় যে বাসগুলো ট্যুর করে ট্যুরিস্টদের নিয়ে, সে বাসে চড়েও আমি কলকাতা ঘুরেছি। কলকাতাকে আমার এমন ভাবে দেখতে ভাল লাগে। কারণ পরেশনাথের মন্দির আমরা কেউ তো চট করে বেড়াতে যাই না। একটা কনডাকটেড ট্যুর হলে তবেই যাই। কলকাতার বিভিন্ন চার্চ, বনেদি বাড়ি, মার্বেল প্যালেস এ সবও ট্যুরিস্টদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখেছি। এক সময় কলকাতায় যে কী বড়লোক ছিল! এখনও কলকাতায় বড়লোক আছে, কিন্তু তাঁদের রুচি সবটাই পাল্টে গেছে। আগেকার দিনে শিল্পী, সাহিত্যিকদের এঁরা হামেশাই পেট্রন করতেন।
অভিনয়ের ছন্দে।
আর একটা বড় বিষয়, কলকাতার খেলা। আমার আর্টিস্ট ফোরামের দৌলতে সৌভাগ্য হয়েছিল খেলা চলাকালীন ইডেন গার্ডেনে খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুমে যাওয়ার। যেটা সচরাচর কারও হয় না। ঢুকতে গেলেই একপাশে রঞ্জিৎ সিং, প্রণব রায়, পঙ্কজ রায়-দের ছবি। এখানে এসে ভিভিয়ান রিচার্ড বসতেন, গাওস্কর বসতেন — সে সব জায়গা ছুঁতে পারা তো আমার কাছে স্বপ্ন! আসলে আমার খিদেটা বরাবরই একটু বেশি। আমি একটা সময় পায়ে হেঁটে শহর চষে বেড়াতাম। কোনও পরিচিত যদি এখনও রাস্তায় ডেকে কথা বলে, আজও আমার তাদের সঙ্গে কথা বলতে কোনও অসুবিধে হয় না। এখনও প্রয়োজন পড়লে মেট্রোতে চলাফেরা করতে পারি। আমার বন্ধু-ভাগ্যটাও ভাল। তারাও সেভাবেই চলা-ফেরা করে।
কলকাতা শহরে কী কী খাবার চাই তোমার! এত ভাল রোল, এত ভাল ফুচকা আর বিরিয়ানি ভাবা যায় না! হায়দরাবাদ মানেই রাজার বিরিয়ানি। আমার কিন্তু তার চেয়ে কলকাতার বিরিয়ানি অনেক বেশি সুস্বাদু লাগে। শুধু তাই নয়, একজন মানুষ মাত্র পঁচিশ টাকায় পেট ভরে ভাত-সব্জি খেতে পারে।
সারা ভারতের চিত্র যদি দেখা যায়, একজন শিল্পী কলকাতার মতো আর কোথাও সুরক্ষিত থাকতে পারে বলে মনে হয় না। তুমি যেমন ইচ্ছা পোশাক পরতে পারো, যে রকম ভাবে ইচ্ছা ঘুরতে পারো। তার মানে এই নয় যে তুমি অসভ্যতা করবে। অর্থাৎ রুচিসম্মতভাবে ভাবে ঘোরা-ফেরার স্বাধীনতা এখনও কলকাতাতে আছে। এমন কোনও শর্তাবলি নেই যে তোমাকে মন্দিরে ঢুকতে হলে সালোয়ার কামিজ পরেই ঢুকতে হবে। এর জন্য আমাদের প্রশাসনকেও আমি ভালই বলব। এটা কোনও রাজনৈতিক মতবাদের ব্যাপার নয়, আমি নিরপেক্ষ একটা জায়গা থেকে বলছি — কলকাতাকে এখন কিন্তু খুব সুন্দর লাগে দেখতে। এয়ারপোর্টের পুরো রাস্তাটা এত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ময়দানে আলো দেওয়া হয়েছে, যার খুব প্রয়োজন ছিল। অন্ধকার থাকত বলে খুব খারাপ কাজ-কর্ম হতো।
আমি আর ক’বছর বাঁচব জানি না। আমার মনে হয় ওই আটটা বছর জীবন থেকে পুরো মুছে দিই, যে সময়টা কলকাতায় ছিলাম না। তখন সত্যিই বুঝেছি কলকাতা কী। এখনও কোনও উত্তর কলকাতার বাড়িতে ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে গেলে তোমাকে এক গ্লাস জলের সঙ্গে দুটো বাতাসা দেবে। তখন মনে হয় এটা কলকাতা। দক্ষিণে আবার গড়িয়া বা একটু ভেতর দিকে গেলে, তুমি রাস্তায় একটু অসুস্থ হয়ে পড়লে দেখবে, পিলপিল করে লোক এসে তোমাকে বাতাস করছে। কোথায় গেলে চিকিৎসা পাবে তার জন্য দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। আসলে সংবাদপত্রে শুধু কলকাতার অমানবিক দিকগুলো ছাপা হয়। এখনও অনেক মানবিক ঘটনা ঘটে চলেছে কলকাতার বুকে, সেগুলো প্রকাশ্যে আসে না। সেগুলোর এখন আর দাম নেই। এখনও আমাদের কলকাতার মধ্যে একটা মিষ্টি, চমৎকার প্রাণ আছে, আন্তরিকতা আছে। পৃথিবীর যে কোনও দেশের শিল্পী এসে কলকাতায় পারফর্ম করতে আলাদা একটা আনন্দ পায়। তার কারণ কলকাতার মানুষ এখনও খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে রিঅ্যাক্ট করতে পারে। অর্ধেক শহর যেটা পারে না। আমাদের হাততালিটা এখনও খুব জো়রে বাজে। সেটা স্টেজ থেকে কাউকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য হলেও, কাউকে বসিয়ে রাখার জন্য হলেও।
কলকাতা থেকে আমার সবটাই প্রাপ্তি। কোনও কিছু কেড়ে নেয়নি এ শহর, দু’হাত ভরে শুধু দিয়েছে। জীবনের রস নিতে জানলে কলকাতা তোমায় দু’হাত ভরিয়ে দেবে। কলকাতা আমাকে উদার হতে শিখিয়েছে। কলকাতা আমাকে প্রেম করতে শিখিয়েছে। কাজের দৌলতে সুদীপা বসু হিসেবে এই শহরে যে ক’জন মানুষ আমাকে চেনে, সবটাই কলকাতা বলেই আমি পেয়েছি। যে মানুষটা শিল্পকে ভালবেসে কাজ করে, টাকা রোজগারের জন্য নয়, তাকে এই সম্মানটা এ শহর ছাড়া কেউ দেবে না। আমি, না সেজেগুজে সহজেই ঘুরে বেড়াতে পারি। অন্য শহরে বাইরের প্যাকেজটা গুরুত্বপূর্ণ। কোন গাড়িতে চলাফেরা করছি, আমি কী পারফিউম মাখছি এ সব। কলকাতায় অনেক স্টুডিওতে গেলে দেখতে পাওয়া যায়, বহু কলাকুশলী এবং টেকনিশিয়ান এক সঙ্গে খাবার খাচ্ছে। যেটা কোনও জায়গায় দেখা যায় না। যে কারণে এখানে একজন শিল্পীকে অপমান করলে কলা-কুশলীরাই রুখে দাঁড়ায়। এই আত্মীয়তা বোধটা এখনও আছে কলকাতায়।
অনুলিখন : পিয়ালী দাস