কলকাতা কি দিল্লি হবে? তবে রাজনীতির নিরিখে নয়, দূষণের নিরিখে।
শুক্রবার পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ (সিএসই) আয়োজিত এক আলোচনাচক্রে উঠে এল এমনই আশঙ্কা। দেশের বিভিন্ন মহানগরীর মধ্যে দূষণের নিরিখে দিল্লি ‘সেরা’। গত নভেম্বরেই দূষণের জেরে ধোঁয়াশায় মুড়ে গিয়েছিল রাজধানী শহর। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, কলকাতার বায়ু যে ভাবে বিষিয়ে উঠছে, তাতে আগামী দিনে এ শহরও এমন ঘটনার কবলে পড়তে পারে।
পরিবেশবিদদের কেউ কেউ বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতাকে লন্ডন করার কথা বলেছিলেন। এ যাবৎকালে দূষণের সব থেকে বড় বিপদ কিন্তু ব্রিটেনের রাজধানীই দেখেছে। ১৯৫২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর, পুরো লন্ডন শহর ধোঁয়াশায় ঢেকে গিয়েছিল। সেই দূষণের প্রকোপে মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৪ হাজার মানুষের।
কিন্তু এই দূষণের উৎস কী? পরিবেশকর্মীদের মতে, শহরের দূষণের পিছনে সব থেকে বেশি দায়ী যানবাহন। এ শহরে বহু বাস, ট্যাক্সি, ণ্যবাহী ট্রাক চলে নিয়মের তোয়াক্কা না করেই। বরং আমজনতার অভিজ্ঞতা বলছে, বেশির ভাগ বাণিজ্যিক গাড়ি থেকে যে ধোঁয়া বেরোয়, তা সহ্য করা কার্যত অসম্ভব। এ শহরে অনেক সময়েই বাসের কালো ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে যায় পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাচ। সিএসই-র সমীক্ষার তথ্য বলছে, গাড়ির দূষণ দেশের বাকি মহানগরীগুলির তুলনায় এ রাজ্যে অনেক কম। কারণ, গাড়ির সংখ্যা এখানে তুলনায় কম। কিন্তু গাড়ির সংখ্যা এবং দূষণের মাত্রা এখানে খুব দ্রুত বাড়ছে।
সিএসই-র সমীক্ষা শুনে পরিবেশকর্মীদের অনেকের বক্তব্য, গাড়ি কম থাকতেই দূষণের নিরিখে দিল্লির সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে কলকাতা। গাড়ি বাড়লে তো পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। সিএসই-র এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর অনুমতি রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘ক্রমাগত বাড়তে থাকা বায়ুদূষণকে আমল না দিলে আগামী দিনে বিপদ মারাত্মক রূপ নেবে।’’ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সূত্র বলছে, অক্টোবর থেকে মার্চ, এই সময়কালে মহানগরীর বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি থাকে। বাকি সময়েও মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হওয়ার ফলে বাতাসে ধূলিকণা বেশি ক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। ‘‘আবহাওয়ার এই সুবিধাটুকু না পেলে সারা বছরই দূষণের জ্বালা সইতে হতো,’’ মেনে নিচ্ছেন পরিবেশ দফতরের এক কর্তা।
তা হলে দূষণ ঠেকাতে পরিবেশ দফতর বা পর্ষদ ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্রের বক্তব্য, ‘‘কোন উৎস থেকে কতটা দূষণ ছড়াচ্ছে, তা মাপার জন্য জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা নিরি-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই তথ্য পেলে আমরা নির্দিষ্ট ভাবে দূষণ রোখার ব্যবস্থা করতে পারব।’’ এই যুক্তি মানতে নারাজ পরিবেশকর্মীদের অনেকেই। পর্ষদেরই প্রাক্তন মুখ্য আইন অফিসার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের মতে, দূষণের উৎস ও তার ভূমিকা পরিবেশ দফতর বা পর্ষদের অজানা নয়। সেই উৎসে আঘাত করলেই দূষণ রোখা সম্ভব। নতুন সমীক্ষার জন্য অপেক্ষার দরকার ছিল না। তিনি বলেন, ‘‘২০০৮-এ হাইকোর্টের নিয়ম মেনে ১৫ বছরের পুরনো গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বাতিল করার পরে দূষণ মাত্রা অনেক নেমেছিল। কিন্তু সক্রিয়তা বন্ধ হওয়ায় ফের দূষণ বাড়ছে।’’ পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, শহরে গাড়ির উপরে নজরদারি কার্যত নেই বললেই চলে। ‘‘কলকাতার রাস্তায় বেশির ভাগ বাস-ট্যাক্সি যা ধোঁয়া ছাড়ে, তাতে সেগুলি কী ভাবে পরিবেশ ছাড়পত্র পায়?’’ প্রশ্ন পার্ক স্ট্রিট এলাকার এক অফিসকর্মীর। এর সদুত্তর কিন্তু মিলছে না।