মশগুল: চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে বাসিন্দাদের আড্ডা। নিজস্ব চিত্র।
পাড়া। এক অমোঘ টান মিশে আছে শব্দটার মধ্যে। যে টান সকলকে বেঁধে রাখে এক সুতোয়। ঝাঁ-চকচকে নিউ আলিপুরের ধার ঘেঁষা এই অঞ্চলটা এখনও আটপৌরে, মধ্যবিত্ত। এটাই আমার পাড়া, সাহাপুর কলোনি। এখন অবশ্য তার নতুন নাম বঙ্কিম মুখার্জি সরণি। তবে লোকে পুরনো নামেই বেশি অভ্যস্ত।
এখানে মূলত পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষজনের বাস। সুবিধা-অসুবিধায় একে অন্যের পাশে থাকেন পড়শিরা। লোকবলের অভাব কখনও অনুভব করিনি। সে জন্যই এ পাড়াটা এখনও প্রাণবন্ত। প্রতিবেশীদের বাড়িতে রান্না করে পাঠানো, উৎসব- অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ— সবই আছে। এখন তো পিকনিকে যাওয়ার গল্প প্রায় শোনাই যায় না। এখানে কিন্তু হৈ হৈ করে পিকনিকে যাওয়াটা রয়ে গিয়েছে।
এই অঞ্চলের বেশিরভাগ বাড়ি এক সময়ে ছিল টালি ও টিনের চালের। তেমন বাড়ি কিছু রয়ে গিয়েছে। তবে সেই পুরনো, বাড়ির জায়গা নিয়েছে ফ্ল্যাট। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখার যে আনন্দ, ফ্ল্যাটের একচিলতে জায়গায় তা কোথায়?
প্রথম যখন আসি, মনে হতো এ পাড়া আমায় কাছে টানবে তো? ধীরে ধীরে সে ভুল ভাঙল। মনে আছে, এক বার পুজোয় পাড়ার মাঠে গান গাওয়ার পরে সকলের মুখে আমার সে কী প্রশংসা!
আমার ভোর হয় আনাজ ফেরিওয়ালার ডাকে। কোনও বাড়ি থেকে রেডিওয় ভেসে আসে বন্দেমাতরমের সুর। আস্তে আস্তে এগিয়ে চলে ঘড়ির কাঁটা। কেউ বেরোন মর্নিং ওয়াকে, কেউ থলি হাতে বাজারে। আসা-যাওয়ার পথে চেনা মুখগুলোর কুশল নেওয়া। আর এরই মাঝে চায়ের দোকানে আড্ডাটা কিন্তু মাস্ট! আসলে ওটাই যে ভাল থাকার রসদ। শুধু সকালেই নয়, রাতে অফিস থেকে ফেরার পথেও অন্তত কিছুক্ষণ আড্ডা না মেরে ঢুকলে যেন মনে হয়, কোথায় একটা ফাঁক থেকে গেল! আড্ডা মানে তো শুধু হাসি-ঠাট্টা নয়, তাতে ঢুকে পড়ে প্রতি দিনের সুখ-দুঃখ, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি— সব কিছুই।
পাড়ার পুজোটা আজও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। চার দিন যে কোথা দিয়ে কেটে যায়, বোঝাই যায় না। একসঙ্গে পাত পেড়ে খাওয়া, মণ্ডপে সকাল থেকে আড্ডা আর দশমীর সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ইদানীং অবশ্য থিম পুজোর ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আটপৌরে পুজোর আমেজটা।
এ পাড়াতেই থাকেন মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। এলাকার মানুষের সুখে-দুঃখে তিনি পাশে থাকেন। এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই ভাল। কাছেই রয়েছে একটি হাসপাতাল। আছে দু’টি বাজারও। সন্ধ্যায় পাড়ার মুখে ফুচকাওয়ালাকে ঘিরে ভিড় জমায় স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা। রয়েছে কয়েকটি ভাল মিষ্টির দোকানও।
পাড়া থেকে এখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি সবুজ। বাড়ি থেকে একটু এগোলেই বীরসা মুণ্ডা পার্ক আর সুরেন দাস শিশু উদ্যান। বিকেলে খুদেদের হইচইয়ে ভরে ওঠে গোটা পার্ক। দেখি, কেউ ব্যস্ত স্লিপ চড়তে, কেউ আবার নামতেই চাইছে না দোলনা থেকে। মনে মনে আমি ফিরে যাই আমার ছেলেবেলায়।
তবে অসুবিধা কি একেবারে নেই? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে লোকসংখ্যা, গাড়ি। সে তুলনায় গ্যারাজের সংখ্যা কম। তাই রাতে রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে থাকে অনেকের গাড়ি।
এমন পাড়া ছেড়ে কোথায় যাব? এক নিশ্চিন্ত পরিবেশ আর নিরাপত্তাই এখানে থাকার বড় প্রাপ্তি।
লেখক চিকিৎসক