বিষণ্ণ: সেলাইয়ের দোকানে উৎপলবাবু। নিজস্ব চিত্র
দুর্গাপুজো, কালীপুজোর সপ্তাহখানেক আগে থেকে হাত দু’টোকে বিরাম দেওয়ার ফুরসত থাকত না তাঁর। সেলাই মেশিনে সুতো ভরা, মাপ করে সুচের সামনে কাপড় ধরা, সময়ে সময়ে হাত দিয়ে মেশিনের চাকা ঘুরিয়ে সেলাইয়ের গতি বাড়ানো..! পা লাগে বটে, কিন্তু তাঁর পেশায় তো হাতের কাজই বেশি।
তবে এ বারের দুর্গাপুজো তাঁর কেটেছে একদম অন্য রকম। আসন্ন কালীপুজোতেও সেই পরিশ্রমের ছিটেফোঁটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই কালীঘাট রোডের উৎপল কর্মকারের। কারণ, গত জুলাইয়ে দু’টি বাসের রেষারেষিতে তাঁর বাঁ হাত কনুই থেকে বাদ যাওয়ার পরে আর নিজের ‘টেলারিং শপ’ খুলতেই পারেন না বছর আটচল্লিশের উৎপলবাবু। ফুটপাতের বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘‘আগে পুজোর মুখে কাজের চাপে রাতে ঘুমোনোর সময় পেতাম না। ঘুম আমার এ বারও হয়নি। তবে মানসিক যন্ত্রণায়।’’
কথায় কথায় উৎপলবাবু ফিরে যান সেই দুর্ঘটনার দিনে। জানালেন, স্ত্রী মীরা এবং বছর চব্বিশের ছেলে অর্চনকে নিয়ে হরিদেবপুরে ভাড়া বাড়িতে থাকেন তিনি। কালীঘাট রোডে শ্বশুরবাড়ির সামনে তাঁর ‘টেলারিং শপ’। স্ত্রীর নামেই দোকানের নাম রেখেছেন ‘মীরা টেলারিং’। আগে প্রতিদিন সকালের সরকারি বাস ধরে দোকান খুলতে আসতেন। গত ২৫ জুলাই সকাল পৌনে ন’টা নাগাদ ওই একই বাসে ওঠেন। তবে সে দিন বাসে এতই ভিড় ছিল যে, ভিতরে ঢুকতে পারেননি বলে উৎপলবাবুর দাবি। কন্ডাক্টরের পাশে বাসের দরজার পাদানিতে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন, ‘‘সামান্য দূর যেতেই এক বৃদ্ধা বাসে ওঠার জন্য হাত দেখান। আমার বাঁ হাত দিয়ে তাঁকে কোনও মতে তুলে নিই। সে সময়েই বাঁ দিক দিয়ে একটি মিনিবাস আমাদের বাসকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করে। আমাদের বাসের চালকও ওই মিনিবাসকে জায়গা দেবে না বলে একেবারে বাঁ দিক ঘেঁষে বেরোতে যায়। তার পরের কথা আর ভাবতেও পারি না।’’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছিলেন, হরিদেবপুর করুণাময়ী মোড়ের কাছে রাস্তার বাঁ দিকে একটি বাড়িতে ধাক্কা মারে উৎপলবাবুদের বাস। বাস থামতে দেখা যায়, রক্তাক্ত অবস্থায় পাদানিতে বসে আছেন এক ব্যক্তি। বাঁ হাত থেকে অঝোরে রক্ত পড়ছে। ওই হাতের অংশ কেটে পড়ে আছে রাস্তার ধারে। কোনওমতে পুলিশ ওই ব্যক্তিকে এম আর বাঙুর হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানেই তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। যদিও ঠিক মতো সংরক্ষণ করতে না পারায় কাটা হাত আর জোড়া লাগানো যায়নি। উৎপলবাবু বলেন, ‘‘পরে জেনেছি, শরীরের কাটা অংশ প্লাস্টিক জাতীয় কিছুর মধ্যে ভরে বরফ চাপা দিয়ে ছ’ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। জল লাগানো চলে না। আমার ক্ষেত্রে হাতটা রাস্তার নোংরার মধ্যে পড়েছিল। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, তাঁরা জুড়ে দিতে পারেন। তবে তাতে পচন ধরবে কি না, বলতে পারবেন না।’’
ঊরু থেকে মাংস কেটে কনুইয়ের থেঁতলে যাওয়া অংশে অস্ত্রোপচার করা হলেও হাত না ফেরায় সে দিনের ঘটনা এক গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করে দিয়েছে উৎপলবাবুদের জীবনে। এক মাস আট দিন হাসপাতালে কাটিয়ে গত অগস্টে কালীঘাটে শ্বশুরবাড়ির ছোট্ট ঘরে ফেরেন উৎপলবাবু। খাট পাতার পরে সেই ঘরে আর কিছুর জায়গা অবশিষ্ট নেই। ঘর লাগোয়া বারান্দায় পাঁপড় বেলেন স্ত্রী মীরাদেবী। সেটাই এখন তাঁদের সংসারের একমাত্র রোজগার। ২৪ বছরের পুত্র শারীরিক অসুস্থতার জন্য কাজ করতে পারেন না।
মন খারাপ হবে বলে পুজোর দিনে কালীঘাটে থাকেননি উৎপলবাবু। হরিদেবপুরে চলে গিয়েছিলেন। তিনি জানান, যখন দোকান করতেন, প্রতিদিনের জন্য তাঁর টাকার আলাদা বটুয়া থাকত। বললেন, ‘‘হয়তো কোনও দিন ৩০০ টাকা আয় হল। পরের দিনের বটুয়ায় দেখলাম, দিনের শেষে পাঁচশো টাকা হয়েছে। ২০০ টাকা বেশি হয়েছে জেনে কী যে আনন্দ হত!’’
মাঝবয়সির চোখেমুখে কোথাও যেন সেই আনন্দ-স্মৃতি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা!