‘মৃতদেহ আগলে আর কত দিন’, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পুরনো সিনেমা হল

১৯২৯ সালে আর্থিক মন্দা কেটে মানুষের হাতে পয়সা আসতে শুরু করে। সেই সঙ্গে চলচ্চিত্রে শব্দ আসে। এই দুয়ের হাত ধরে বিনোদনের নতুন মাধ্যম পান গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে আসা মানুষ।

Advertisement

জয়তী রাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৯ ০০:২৪
Share:

শূন্যতা: নামগুলি টিকে আছে। বাকিটা ইতিহাস। নিজস্ব চিত্র

সদ্য ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছিলেন বছর ঊনত্রিশের এক যুবক। খবর পেলেন, হেমন্তকৃষ্ণ মিত্র নামে তাঁর পরিচিত এক ব্যক্তি কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের ফাঁকা জমিতে ভাড়া বসাতে ম্যানসন তৈরি করতে চলেছেন। দ্রুত তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে বায়োস্কোপ দেখাতে জমি লিজে নিলেন।

Advertisement

তিরিশ বছরের লিজের প্রথম দশ বছর প্রতি মাসে ৩০০ টাকা, পরবর্তী দশ বছরে মাসিক ৪০০ টাকা এবং তার পরবর্তী দশ বছর মাসিক ৫০০ টাকা জমির ভাড়া ধার্য করলেন হেমন্তকৃষ্ণ। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার যুবক বীরেন্দ্রনাথ সরকার বায়োস্কোপে গল্প দেখাতে সেখানে একটি বাড়ি করলেন। ১৯৩০ সালের শেষে ‘চিত্রা’ নামে সে বাড়ির দ্বারোদ্ঘাটন করেন তৎকালীন মেয়র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তাঁর উদ্বোধনী ভাষণে স্বদেশী সিনেমা তৈরির ডাকে অনুপ্রাণিত বীরেন্দ্রনাথ এর কিছু মাস পরেই তৈরি করেন নিউ থিয়েটার্স। বীরেন্দ্রনাথ, ভারতীয় চলচ্চিত্রে বি এন সরকার নামে পরিচিত। প্রেক্ষাগৃহের বর্তমান মালিক দীপেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্রের স্মৃতিতে, “পূর্ণ দৈর্ঘ্যের বাংলা সবাক ছবি দেনাপাওনা, যা দেখিয়ে যাত্রা শুরু চিত্রার। ১৯৬০ সালে লিজ পরবর্তী লড়াই গড়ায় কোর্টে। মামলা জিতে ১৯৬৩ সালে ঠাকুর্দা হেমন্তকৃষ্ণ দায়িত্ব নিয়ে নতুন নাম দেন মিত্রা।”

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

Advertisement

চলচ্চিত্রে শব্দ আসার পরে অর্থাৎ গত শতকের ৩০-৫০ এর দশকের মধ্যে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট অধুনা বিধান সরণি ও তার আশপাশে সিনেমা দেখাতে একাধিক প্রেক্ষাগৃহ হয়েছিল। মিত্রা, রূপবাণী, শ্রী, উত্তরা, রাধা, খান্না, দর্পণা, মিনার, বীণা, পূর্ণশ্রী, বিদুশ্রী, সুরশ্রী, টকিশো হাউস, থিয়েটার হল থেকে বদলে হওয়া প্রেক্ষাগৃহ গ্রেস। দর্শকের ভিড় সামলাতে নাজেহাল হাতিবাগানের নামই হয়ে গেল ‘সিনেমা পাড়া’। আরও এক প্রেক্ষাগৃহ যা অনেক কাল আগে ধূলিসাৎ হলেও টিকে আছে এলাকার নামে। গণেশ টকিজ। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছেন, “গণেশ টকিজের সঙ্গে নাম জড়িয়ে আছে বাংলা চলচ্চিত্রের স্রষ্টা হীরালাল সেনের। ব্যবসায়ী রাম দত্তকে নিয়ে ১৯১৪ সালে এটি তৈরি হয়েছিল প্রথমে অন্য নামে।” ওই সময়ের আশপাশে ১৩৮, কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে তৈরি হয় আরও একটি প্রেক্ষাগৃহ, কর্নওয়ালিস। নির্বাক ছবি সত্যবাদী রাজা হরিশচন্দ্র দেখানো হয় সেখানে। তিরিশের দশকে বন্ধ হয় সেটি।

১৯২৯ সালে আর্থিক মন্দা কেটে মানুষের হাতে পয়সা আসতে শুরু করে। সেই সঙ্গে চলচ্চিত্রে শব্দ আসে। এই দুয়ের হাত ধরে বিনোদনের নতুন মাধ্যম পান গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে আসা মানুষ। তখনও দক্ষিণ কলকাতার সে ভাবে জন্ম হয়নি। মধ্য কলকাতা ছিল মূলত সাহেবপাড়া এবং প্রশাসনিক কার্যালয়। ফলে ওঁদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠল উত্তরের আহিরীটোলা, শোভাবাজার, হাতিবাগান অঞ্চল। পাঁচালী, যাত্রা, কীর্তন, ছড়া পরিত্যাগ করে আসা বাঙালির কাছে জনপ্রিয়তা পেল চলচ্চিত্র। সঞ্জয়বাবু এর মূলে তিনটি কারণ দেখছেন। এক, এটি সাক্ষরতার দাবি করে না। দুই, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তিন, আরবান ফোকলোর বা শহুরে এই লোককথায় গান-নাচ-গল্প সব একসঙ্গে পাওয়া যায়। ফলে সিনেমা তৈরি করা এবং দেখানোর ব্যবসা ফুলে উঠতে লাগল।

প্রেক্ষাগৃহগুলি ঘিরে হাতিবাগান বাজারের বাইরে জমে উঠতে থাকে জামাকাপড় আর খাবারের দোকান। সিনেমা দেখা ছাড়াও বিনোদনের পরিবর্তন শুরু তখন থেকেই। নব্বইয়ের দশকে সিনেমা হলের ব্যবসায় মন্দা টানল ঘরে ঘরে রঙিন টিভি আর কেবল। যেটুকু হলের ভিড় ছিল সেটাও টেনে নিল মাল্টিপ্লেক্স।

একে একে নিভিছে দেউটি। এখন টিকে শুধু মিনার এবং টকি শো হাউস। মিত্রার শেষ দিন, চলতি বছরের ৩০ মার্চেও ভিড় ছিল ভালই। কাকতালীয় ভাবে ৮৪ বছর আগে ওই দিন এই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল প্রমথেশ বড়ুয়ার দেবদাস। যে সিনেমা নাড়িয়ে দিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল। যাবতীয় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আসন ভরানোর লড়াই শেষ পর্যন্ত চালিয়ে গিয়েছিল মিত্রা। শুধু পরের প্রজন্মের ব্যবসা চালানোর মানসিকতাটা ছিল না। যে কারণে বন্ধ করতে হল বলে জানাচ্ছেন অসুস্থ দীপেন্দ্রকৃষ্ণবাবু।

মিত্রার সঙ্গেই শুরু হয়েছিল টকি শো হাউস। প্রথম প্রদর্শিত সিনেমা ‘অ্যাক্রস টু সিঙ্গাপুর’। ইংরেজি সিনেমাপ্রেমীদের জন্য রবিবারের সকালে থাকত সেখানে বিশেষ উপহার। পথের পাঁচালী তখনও হয়নি। এক সকালে সের্গেই আইজেনস্টাইনের ‘ইভান দ্য টেরিবল’ দেখতে সেখানে পৌঁছে যান সত্যজিৎ রায়, জানাচ্ছেন সঞ্জয়বাবু। বর্তমান মালিক নির্মল দে-র কথায়, “মাল্টিপ্লেক্সে সাড়া ফেলা সিনেমা দেখতেও এখানে ১২-২০ জন দর্শক আসেন। যে কোনও দিন হল বন্ধ করতে বাধ্য হব।”

১৯৪২ সালে তৈরি হয়েছিল মিনার। কোনও রকমে ব্যবসা আগলাচ্ছেন সোমনাথ পাল। উল্টো দিকের বন্ধ মিত্রার দিকে তাকিয়ে এক কর্মীর দীর্ঘশ্বাস― মৃতদেহ আগলে আর কত দিন!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement