(বাঁ দিকে) শপিং মলের ভিতরের দৃশ্য। তাপস হালদার (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
চোখের সামনে আগুনের ফুলকি পড়ছিল। যেটুকু অক্ষত ছিল, একে একে সবেতেই আগুন ধরে যাচ্ছিল। ধোঁয়ায় এমন অবস্থা যে, ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। ‘আগুন আগুন’ আর্তনাদ করে শপিং মল জুড়ে তখন লোকজন ছুটছেন! আগুনের জন্য লিফ্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তা দেখে আমরাও সিঁড়ির পথ ধরি। কিন্তু, সেখানে তখন হাঁটার জায়গা নেই। প্রচুর বস্তা ফেলা। কী ভাবে যে প্রাণ হাতে করে বেরিয়েছিলাম, ভাবতে পারছি না! এ দিকে বৌ আর মা ঘন ঘন ফোন করে চলেছেন। বেঁচে আছি। ওঁদের যে আবার দেখতে পাব, এটাই বড় কথা।
কসবার অ্যাক্রোপলিস মলের একটি রেস্তরাঁয় চার বছর ধরে কাজ করছি। রোজের মতো শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে ইএম বাইপাস লাগোয়া ধামাইতলার বাড়ি থেকে কাজে চলে এসেছিলাম। বেলা ১১টা নাগাদ আমাদের রেস্তরাঁ খুললেও ক্রেতাদের দেখা মেলে বেলা ১২টার পরে। এ দিনও স্টোরে আমরা ২০ জন মতো কর্মী ছিলাম। হঠাৎ খেয়াল হল, ‘ফায়ার অ্যালার্ম’ বাজছে। তবে সেটি মাঝেমধ্যেই বাজে বলে কেউই গ্রাহ্য করিনি। আসলে এ দিন যে তত ক্ষণে বিপদ ঘটে গিয়েছে, তা কে জানত!
আমাদের স্টোর পাঁচতলায়। তার নীচেই চারতলা ও পাঁচতলার মাঝের একটি ফ্লোরে রয়েছে বইয়ের দোকান। সেখানে সকাল থেকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের কোনও কাজ চলছিল। তার জন্য ঝালাই যন্ত্রও ব্যবহার হচ্ছিল। দেখি, সেই বইয়ের দোকানটাই দাউ দাউ করে জ্বলছে। তখন উপরতলায় আমাদের স্টোরেও আগুন পৌঁছে গিয়েছে। কোন দিকে ছুটব, বুঝতে পারছিলাম না। বইয়ের দোকানের দিকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে দেখি, সেখানে ধোঁয়া আরও বেশি। আগুনের হলকা গায়ে লাগছিল। কোনও মতে পিছন দিকের সিঁড়ি ধরলাম। সেখানে তখন কাতারে কাতারে মানুষ। একুশতলা শপিং মল থেকে তখন সকলেই প্রাণ হাতে নিয়ে বেরোতে চান। আমিও সেই ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। এমনই হুড়োহুড়ি আর ভিড় যে, কেউ কেউ পড়ে গেলেন। নিজেকে বাঁচানোর এমনই তাড়া সকলের যে, কেউই কাউকে সাহায্য করছিলেন না। দেখলাম, এক মহিলা কিছুতেই নীচের দিকে নামতে পারছেন না। জানা গেল, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। কোনও মতে তাঁকে এক জায়গায় বসানো হল।
সমস্যা আরও বাড়ল তেতলায় নামার পরে। সেখানে ১২ ফুট চওড়া সিঁড়ির বেশির ভাগটাই নানা জিনিসের স্তূপে ঢাকা। কোনও মতে সেই সরু জায়গা দিয়েই দ্রুত পায়ে সকলে নামছিলেন! নীচে তত ক্ষণে দমকলের গাড়ি এসে পৌঁছে গিয়েছিল। আগুন নেভানোর চেষ্টার পাশাপাশি দমকলকর্মীরা শপিং মলের কাচের দেওয়াল ভাঙার চেষ্টাও করছেন। দমবন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থায় দেখি, সামনে বেরোনোর দরজা। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মনে পড়ল, সঙ্গের ব্যাগটা উপরেই ফেলে এসেছি। কিন্তু, আর আনার উপায় নেই। প্রাণ নিয়ে যে ফিরেছি, সেটাই বড় কথা।
(শপিং মলের রেস্তরাঁর কর্মী)