ভোর সওয়া পাঁচটা। বৈশাখী আইল্যান্ড থেকে পূর্ত ভবন আইল্যান্ড যাওয়ার রাস্তায় দেখা যায়, টি-শার্ট ও হাফপ্যান্ট পরা বছর তেতাল্লিশের এক ব্যক্তি ফুটপাথের ধারে পড়ে রয়েছেন। চারদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওই রাস্তাতে রোজ অনেকেই প্রাতর্ভ্রমণ করেন। কারওরই চোখ পড়েনি ওই ব্যক্তির দিকে।
ঘটনাটি বৃহস্পতিবারের। কিছুক্ষণ পরে কাগজকুড়ানি এক মহিলা প্রথম ওই রক্তাক্ত দেহটি দেখতে পেয়ে রীতিমতো আঁতকে ওঠেন। ঘটনাচক্রে সে সময়ে কাছেই ছিলেন সিভিক পুলিশের এক কর্মী। ওই মহিলা হাত দিয়ে ইশারা করে সেই পুলিশকর্মীকে ডেকে দেহটি দেখান।
সিভিক পুলিশের কাছ থেকে সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছন এক পুলিশ অফিসার। কোনও মতে ওই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করেন তিনি। পরে সল্টলেকের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় ওই ব্যক্তিকে। সেখানেই দুপুর সওয়া ১টা নাগাদ মারা যান তিনি।
পুলিশ জানিয়েছে, মৃতের নাম কার্তিক সাহা (৪৩)। তাঁর বাড়ি বৈশাখী আবাসনে। বিকাশ ভবনে উচ্চশিক্ষা দফতরে কাজ করতেন কার্তিকবাবু। এই ঘটনায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন তাঁর এক আত্মীয়। অভিযোগের ভিত্তিতে এ দিনই বৈশাখী আবাসন থেকেই কুন্তল সামন্ত নামে এক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
ঠিক কী ঘটেছিল এ দিন ভোরে? পুলিশ সূত্রে খবর, রোজকার মতো এ দিনও পাঁচটা নাগাদ প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন কার্তিকবাবু। সিজি ব্লকের ২৩৮ নম্বর বাড়ির সামনে ফুটপাথ দিয়ে যাওয়ার সময়ে আচমকা পিছন থেকে কুড়ুল জাতীয় কিছু দিয়ে কেউ কার্তিকবাবুর মাথায় আঘাত করে। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। মাথা ফাঁক হয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে পরে উদ্ধার হয়েছে ওই অস্ত্রটিও।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই ব্যক্তির মাথার পিছনে গভীর ক্ষত ছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণও হয়েছিল। কুড়ুল দিয়ে মারার ফলে তাঁর মাথা ফাঁক হয়ে গিয়ে হাওয়া ঢুকে গিয়েছিল। তার জেরেই ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর।
প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জেনেছে, মাস আটেক আগে থেকে কার্তিকবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে কুন্তলের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে কার্তিকবাবুর পরিবারেও একাধিক বার অশান্তি হয়। কিন্তু সমস্যা তো কমেইনি, উল্টে তীব্র আকার নেয়। এর পরে কার্যত সালিশির ধাঁচে কার্তিকবাবু ও কুন্তলের পরিবার আলোচনা করে সমঝোতার রাস্তায় আসে।
স্থানীয় সূত্রে পুলিশ আরও জেনেছে, মাসখানেক আগে ফের সমস্যা মাথা চাড়া দেয়। কুন্তল একটি দামী ফোন উপহার দেয় কার্তিকবাবুর স্ত্রীকে এবং তাঁদের একমাত্র সন্তানকে জুতো কিনে দেয়। তা নিয়ে ফের অশান্তি শুরু হয় কার্তিকবাবুর পরিবারে। কুন্তলকে সতর্ক করেন কার্তিকবাবু। কিন্তু অভিযোগ, তখনই পাল্টা দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল কুন্তল।
বৃহস্পতিবারের ঘটনার পরে কথা বলার অবস্থায় নেই কার্তিকবাবুর বৃদ্ধা মা ফুলমালা দেবী। এ দিন বাড়িতে বসে তিনি বলেন, ‘‘গত কয়েক দিন ধরে বৌমাকে বেরোতে দেওয়া হচ্ছিল না। তা নিয়ে অশান্তিও চলছিল। কত বার বুঝিয়েছিলাম। কিন্তু তার জন্য আমার ছেলেকে যে এমন খেসারত দিতে হবে, তা ভাবিনি।’’ কার্তিকবাবুর একমাত্র সন্তান, বছর ১৪-র ছেলেকে নিয়েই এখন চিন্তায় পড়েছেন প্রতিবেশীরা।
সল্টলেকে চুরি, ছিনতাই হলেও সাম্প্রতিক কালে খুনের ঘটনা ঘটেনি। পুলিশ সূত্রে খবর, বছর দশেক আগে সল্টলেকের একটি আবাসনে এক মহিলা খুন হয়েছিলেন। এ ছাড়া, তারও আগে দত্তাবাদে রাজনৈতিক কারণে একটি খুনের ঘটনা ঘটেছিল। ফলে এ দিন ভোরের ওই ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে সল্টলেকে। বিশেষত প্রাতর্ভ্রমণকারীদের মধ্যে।
পাশাপাশি, প্রশ্নের মুখে পড়েছে পুলিশি নজরদারিও। যদিও পুলিশকর্তাদের দাবি, আগের চেয়ে চুরি, ছিনতাই কমেছে সল্টলেকে। তবে এ দিনের ঘটনা ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণেই বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান। তাদের আরও দাবি, সে সময়ে কাছেই
সিভিক পুলিশকর্মী থাকায় দ্রুত ওই ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে।
ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে বৈশাখী আবাসনেও। সকাল থেকে ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই প্রতিবেশীরা ভিড় করেন কার্তিকবাবুর বাড়িতে। তাঁরা জানান, অত্যন্ত শান্ত, মিশুকে স্বভাবের ছিলেন কার্তিকবাবু। তাঁর যে এমন পরিণতি হবে, তা ভাবতে পারছেন না তাঁরা।
পুলিশ জানিয়েছে, সল্টলেকের এফডি মার্কেটে কুন্তলের বৈদ্যুতিন সামগ্রীর একটি দোকান রয়েছে। এ ছাড়া সে জমির দালালির কাজও করত। ওই যুবক সম্পর্কে এফডি ব্লক-সহ ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, তৃণমূলের বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই ছেলেটি সম্পর্কে নানা অভিযোগ আগেও এসেছিল। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও করা হয়েছে।’’