স্বাগত: প্রার্থনায় এবং পার্টিতে নতুনকে বরণের প্রথা আগেও ছিল, আজও আছে। বদলেছে শুধু ধরন। সৌজন্যে আনন্দবাজারের আর্কাইভ
“খৃষ্ট মতে নববর্ষ অতি মনোহর।
প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর।।
চারু পরিচ্ছদযুক্ত রম্য কলেবর।
নানা দ্রব্যে সুশোভিত অট্টালিকা-ঘর।।”
“সাহেবের ঘরে ঘরে কারিগুরি নানা।
ধরিয়াছে টেবিলেতে অপরূপ খানা।।
বেরিবেণ্ট সেরিটেণ্ট মেরিমেণ্ট যাতে।
আগে ভাগে দেন গিয়া শ্রীমতীর হাতে।।”
“সুখের সখের খানা হলে সমাধান।
তারা রারা রারা রারা সুমধুর গান।।
গুড়ু গুড়ু গুম গুম লাফে লাফে তাল।
তারা রারা রারা রারা লালা লালা লাল।।”
“সাহেবের হুড়াহুড়ি জাহ্নবীর জলে
করিতেছে “বোটরেস” সেলর সকলে।”
প্রত্যক্ষদর্শী কবি এবং সংবাদপ্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক ঈশ্বর গুপ্তের কলমে এ ভাবেই ধরা রয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে কলকাতায় ইংরেজি নববর্ষ। সাজানো অট্টালিকার টেবিলে থরে থরে খাবারে জমে উঠত আসর। ভোজন শেষে শুরু হত নাচ। নববর্ষে সাহেবদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল নৌকা বাওয়া প্রতিযোগিতা।
অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে এ শহরে ইংরেজি নববর্ষ পালনের ছবি পাওয়া যায় হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ বই থেকে। ১৯১৫ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ে লেখা, ১৩০ বছর আগে কী ভাবে নববর্ষ পালন হয়েছিল। তৎকালীন ইংল্যান্ডেশ্বরীর জন্মদিন উপলক্ষে ১ জানুয়ারি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ থেকে তোপধ্বনি হয়েছিল। বিকেলে গভর্নর লর্ড কর্নওয়ালিস একটি নাচ এবং ভোজসভার আয়োজন করেন। মিসেস চ্যাপম্যানের নাচ, ভোজ এবং বাঈনাচ চলেছিল ভোর চারটে পর্যন্ত। ওই বই থেকেই জানা যায়, বিংশ শতকের শুরুতে নববর্ষ পালন হত গড়ের মাঠে কুচকাওয়াজ, সৈন্য প্রদর্শনী এবং উপাধি বিতরণ করে।
শুধুমাত্র গভর্নর বা সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলিতেই নয়, নববর্ষ ঘরোয়া ভাবেও পালন হত। কলকাতার ইতিহাস নিয়ে চর্চা করা অমিতাভ পুরকায়স্থ জানালেন, ১৮৩১ সালের ১ জানুয়ারি এক ঘরোয়া পার্টির কথা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন এ দেশে ২৪ বছর কাটানো ভ্রমণ লেখিকা ফ্যানি পার্কস। মহার্ঘ বরফ মদে মিশিয়ে পান করার কথা সেখানেই পাওয়া যায়।
এ দিকে ইউরোপীয় উপনিবেশ বিস্তারের সঙ্গেই শহুরে সমাজের সর্ব স্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ইংরেজি নববর্ষের আকর্ষণ। প্রায় ৭০ বছর আগে বড়দিন উপলক্ষে বাংলা ক্যারল তৈরি হত। সুনীল দত্ত, মানিক নাথ, অনিল সরকার এবং নির্মল পাণ্ডের মতো শিল্পীরা সুর এবং কথা দিতেন। অনেকটা পুজোর গানের মতোই।
১ জানুয়ারি বলতে ক্রিশ্চিয়ান বেরিয়াল বোর্ড অব কলকাতার ম্যানেজিং মেম্বার রণজয় বসুর মনে পড়ে, প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে পরিবারের বড়দের সঙ্গে জলাজঙ্গলে ভরা আজকের সল্টলেকে পাখি শিকার করতে যাওয়ার দিন ওটা। একটা বয়স পর্যন্ত ওই দিন সার্কাসের জন্য বাঁধা ছিল। বড়দিনে পাওয়া পোশাক থেকে একটি সরিয়ে রাখতেন বছরের প্রথম দিন পরার জন্য। খিদিরপুর আর নেতাজি সুভাষ ডকে দাঁড়ানো জাহাজগুলি ৩১ ডিসেম্বরের রাত ১২টায় একসঙ্গে ভোঁ আওয়াজ তুলত। তা শুনতে অনেকের মতো তিনিও গাড়ি দাঁড় করাতেন। ১৯৫৮ সালে তিনি তখন সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজের ছাত্র। ওই দিনটি তিনি ও তাঁর
বন্ধুদের কাছে ছিল নিজেকে বড় ভাবার দিন। তাই দেদার সিগারেট টেনেই আনন্দ মিলত। লোরেটো হাউসে মেয়েদের দেখতে যাওয়ার দিনও তাঁদের ছিল ওই তারিখটাই।
বো ব্যারাকের বাসিন্দা বছর ছাপ্পানোর ফেলিক্স অগাস্টিনের কাছে আবার নতুন বছর মানে পারিবারিক জমায়েত। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টায় বাড়িতে ধূপ-মোমবাতি জ্বালিয়ে, ফুল দিয়ে উপাসনা করতেন তাঁরা। সঙ্গে থাকত নতুন গুড়ের চালের পায়েস। আরম্ভের ক্ষণ আসত সশব্দে। তবে বাজি পুড়িয়ে নয়, বয়স্কেরা হাঁড়ি বাজিয়ে রাস্তায় বেরোতেন। কোথাও বাজত শঙ্খ, কোথাও বা বিউগল। রোস্ট, হ্যাম, সালামি আর ওয়াইন দিয়ে পারিবারিক ভোজ হত। বনফায়ার ছিল আবশ্যিক। গানে, গিটারে আর ওয়াইনের আমেজে শুরু হত বছর।
মধ্যবিত্তের নাগালে আসা ক্লাব, রেস্তরাঁর হাতছানি আর স্মার্টফোনের দাপট উৎসবের ধরনে বদল এনেছে। একে একে স্মৃতির ঝাঁপিতে উঠে পড়েছে নিউ মার্কেটের জনপ্রিয় কেকের দোকান ওয়াইজ়, এম এক্স ডি-গামা। চৌরঙ্গীর ফার্পোজ এবং পার্ক স্ট্রিটের ফেরেজ়ানি, অ্যারিজ়োনার মতো সুইশ কেকের দোকানও উঠে গিয়েছে কবে!
সেই সময়ে নববর্ষ পালন করে নজরে কেড়েছিল কমলালয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। তারই যেন পশ্চিমী সাজ আজকের শপিং মলগুলিতে। পান-ভোজন আর উদ্দাম নাচে রাত জাগা শহরকে দেখলে হয়তো আরও এক বার ঈশ্বর গুপ্ত বলে উঠতেন―
“সুখের সখের খানা হলে সমাধান।
তারা রারা রারা রারা সুমধুর গান।।
গুড়ু গুড়ু গুম গুম লাফে লাফে তাল।
তারা রারা রারা রারা লালা লালা লাল।।”