ইতিহাসের পথে খোঁজ বিস্মৃত নারীদের

তাঁদের সেই সব না-শোনা, না-বলা কথা সাজিয়েই রবিবার সকালে একটি সংস্থার উদ্যোগে হয়ে গেল হেরিটেজ ওয়াক। কখনও পুরনো চিঠি, কখনও স্মৃতিকথা— একটি একটি টুকরো জুড়ে অষ্টাদশ শতকের কলকাতার সেই নারীদের সামনে আনলেন এ দিনের সূত্রধর সাচিকা ঘোষ।

Advertisement

সুনীতা কোলে

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৪৮
Share:

পায়েপায়ে: পার্ক স্ট্রিট সমাধিক্ষেত্রে হেরিটেজ ওয়াকে উৎসাহীরা। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ

পার্ক স্ট্রিট সমাধিক্ষেত্র বললেই শোনা যায় কিছু পরিচিত নাম। ডিরোজিয়ো, উইলিয়াম জোন্স, চার্লস স্টুয়ার্ট। এমনকি, ওয়াল্টার ল্যান্ডর ডিকেন্সের নামও করেন কেউ কেউ। কিন্তু সেই সময়ের মহিলারা? ২৫০ বছরের পুরনো এই সমাধিক্ষেত্রে তো শায়িত রয়েছেন তাঁরাও। অথচ তাঁদের কথা শোনা যায় বড় কম।

Advertisement

তাঁদের সেই সব না-শোনা, না-বলা কথা সাজিয়েই রবিবার সকালে একটি সংস্থার উদ্যোগে হয়ে গেল হেরিটেজ ওয়াক। কখনও পুরনো চিঠি, কখনও স্মৃতিকথা— একটি একটি টুকরো জুড়ে অষ্টাদশ শতকের কলকাতার সেই নারীদের সামনে আনলেন এ দিনের সূত্রধর সাচিকা ঘোষ।

সাচিকা জানালেন, আবহাওয়ার সঙ্গে মানাতে না পারা আর সন্তানের জন্ম— তখন অধিকাংশ ইংরেজ মহিলার মৃত্যু হত এই দু’টি কারণেই। গোটা সমাধিক্ষেত্র জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তারই অজস্র প্রমাণ। যেমন এলিজ়াবেথ জেন বারওয়েল। সুন্দরী বলে খ্যাতি ছিল তাঁর। শোনা যায়, একবার তাঁর সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য দরবার করেছিলেন ১৬ জন বিবাহযোগ্য পুরুষ। সকলকে নিরাশ করে এলিজ়াবেথ অবশ্য বিয়ে করেন আইনজীবী, ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির কাউন্সিল সদস্য ও ওয়ারেন হেস্টিংয়ের ঘনিষ্ঠ রিচার্ড বারওয়েলকে। কিন্তু ১৭৭৮ সালে বিয়ের দু’বছরের মাথায়, তেইশ বছর বয়সে মৃত্যু হয় এলিজ়াবেথের।

Advertisement

লেডি অ্যান মনসন অবশ্য তখনকার নিরিখে দীর্ঘ জীবন লাভ করেছিলেন। রাজা দ্বিতীয় চার্লসের প্রপ্রৌত্রী, ডার্লিংটনের আর্ল-এর বড় মেয়ে অ্যান কলকাতায় এসেছিলেন দ্বিতীয় স্বামী জর্জ মনসনের সঙ্গে। কলকাতার পশ্চিমি সমাজে অ্যান অবশ্য শুধু পারিবারিক কারণেই বিখ্যাত ছিলেন না। পঞ্চাশ বছরের জীবনে উদ্ভিদবিদ এবং উদ্ভিদ সংগ্রাহক হিসেবে রীতিমতো খ্যাতিলাভ করেন তিনি। কলকাতায় আসার পথে দক্ষিণ আফ্রিকায় সুইডিশ বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াসের এক ছাত্রের সঙ্গে কাজ করেন অ্যান। লিনিয়াস পরে অ্যানের সংগ্রহ করা একটি গাছের প্রজাতির নাম দেন— মনসনিয়া। বছর কয়েক আগে অ্যানের বংশধরদের উদ্যোগে সংস্কার করা হয়েছে তাঁর সমাধিটির।

অকালে ঝরে যাওয়া প্রেমের কাহিনি হয়ে এই সমাধিক্ষেত্রেই ঘুমিয়ে আছেন রোজ় অ্যালমার। কবি ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডরের সমনামী কবিতার অনুপ্রেরণা তিনিই। শোনা যায়, তরুণ কবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বন্ধ করতেই ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অষ্টাদশী রোজ়কে। শহরে আসার দু’বছর পরেই কলেরায় ভুগে মারা যান রোজ়। উইলিয়াম ডালরিম্পলের ‘হোয়াইট মুঘলস’ বইয়েও উল্লেখ রয়েছে সেই ঘটনার। মৃত্যুর খবর ইংল্যান্ডে পৌঁছলে স্মৃতি ও দীর্ঘশ্বাসের উল্লেখ করে একটি শোকবার্তা পাঠান ওয়াল্টার। সম্ভবত রোজ়ের এক আত্মীয়ার উদ্যোগে সেটি স্থান পেয়েছে ওই সমাধিতেই।

উইলিয়াম হিকির স্মৃতিকথায় রয়েছে প্রথম স্ত্রী শার্লট হিকির কথা। শান্ত, সুন্দর, নম্র শার্লটও দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার ধকল নিতে পারেননি। কয়েক মাস পরে বড়দিনে মৃত্যু হয় তাঁর। তিনিও রয়ে গিয়েছেন এই সমাধিক্ষেত্রে। সব ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে টিকে থাকার মতো নারীরাও অবশ্য ছিলেন কলকাতার পশ্চিমী সমাজে। তাঁদেরই এক জন মেরি বাওয়ার। ১৭৫৬ সালে সিরাজদ্দৌলা কলকাতা দখল করার পরে যাঁরা ফলতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, তাঁদেরই এক জন মেরি। নথি বলছে, সেখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অনেকেই। মৃত্যুও হয় অনেকের। কিন্তু সব বিপত্তি পেরিয়ে মেরি আবার শহরে ফিরে এসেছিলেন। বেঁচেছিলেন ১৭৮১ সাল পর্যন্ত।

সমাধিক্ষেত্রের অনেকটা জুড়েই রয়েছে এমন মহিলাদের সমাধি। কারও ফলকে রয়েছে জন্ম-মৃত্যুর তারিখ, স্বামী কিংবা বাবার নাম, প্রিয়জনের স্মৃতিচারণ। কারও আবার সেটুকুও নেই। তাঁদের জীবন ঢাকা পড়েছে ২০০ বছরের বিস্মৃতির অন্তরালে। রবিবাসরীয় সকালে কিছুটা হলেও সরে গেল সেই বিস্মৃতির পর্দা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement