Durga Puja 2022

মা-হারা মেয়ের পাশে মমতার মা ‘অন্নপূর্ণা’

তাঁর নিজের ঘরে ভাতের অভাব তো কী হয়েছে! ভালবাসার কমতি নেই। তাই ডেঙ্গিতে মৃতা প্রতিবেশী মলিনা দাসের মেয়ে রঞ্জিতার খানিকটা মায়ের মতোই তিনি।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:০৭
Share:

মমতাময়ী: ছেলে বিশ্বের সঙ্গে মা আলপনা মণ্ডল। ছবি: রণজিৎ নন্দী

সদ্য মাকে হারিয়েছে এক মেয়ে। তারই পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রতিবেশী এক মহিলা। তাঁর নিজের ঘরে ভাতের অভাব তো কী হয়েছে! ভালবাসার কমতি নেই। তাই ডেঙ্গিতে মৃতা প্রতিবেশী মলিনা দাসের মেয়ে রঞ্জিতার খানিকটা মায়ের মতোই তিনি। পুজোর রোশনাইয়ের নীচে যে আঁধার, তা ঘুচিয়ে দিতে কোমর বেঁধেছেন বাগবাজারের হাজার বস্তির বাসিন্দা আলপনা মণ্ডল। ভাবছেন, ‘‘যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় নয় জন।’’

Advertisement

অথচ, বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে উপার্জন তাঁর। নিজের ছেলেমেয়ের দায়িত্বও রয়েছে। শত অনটনেও বন্ধ করেননি দুই সন্তানের পড়াশোনা। মেয়ের নাম মমতা, একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। ছেলে বিশ্ব নবম শ্রেণির পড়ুয়া। স্থির করেছেন, অর্থকষ্ট সত্ত্বেও এখনই মেয়ের বিয়ে দেবেন না। মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করবে। ভাই যত দিন চাকরি না পাচ্ছে, তত দিন ওই মেয়েই সংসার সামলাবে।

বছর আটত্রিশের আলপনার শরীরে এখনও দগদগে ঘা। বেকার স্বামী। স্ত্রীর রোজগারে খেয়েও মারধর করত স্ত্রীকেই। স্বামীর কথা মতো কাজ না করলেই মার। যখন চাইত তখনই দিতে হত নেশার টাকা। পান থেকে চুন খসলেই ঘর বন্ধ। রাস্তায় শুতে হত আলপনাকে। অত্যাচারের কাহিনি শেষ হয়েছিল আচমকা। মাস গিয়ে বছর কাটে, তবু বেপাত্তা স্বামীর খোঁজ মেলে না। দীর্ঘদিন থানা-পুলিশ করে আশা ছেড়ে দেন স্ত্রী। লড়াই ছাড়েননি।

Advertisement

লড়াইয়ের স্বপ্ন বোনার মধ্যেই পুজোর আগে রঞ্জিতার পাশে দাঁড়িয়েছেন আলপনা। এলাকায় লোকে তাঁকে মমতার মা বলেই চেনেন। আলপনা বলে চলেন, ‘‘দিন পনেরো আগে ওর মা মারা গিয়েছে। ওর বাবা আর দুই দাদা আছে। তবুও আমার ছেলে-মেয়েকে যেমন ভাবে আগলে রাখি, সে ভাবেই আগলে রাখব ওকে।’’

২০২১ সালের জানুয়ারিতে ভয়াবহ আগুনে ভস্মীভূত হয় হাজার বস্তি। সর্বস্ব খুইয়ে সন্তানদের নিয়ে অন্যদের সঙ্গেই আলপনার ঠাঁই হয় বাগবাজারের নিবেদিতা উদ্যানে। ছাদ বলতে প্লাস্টিক আর ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে স্থানীয় কাউন্সিলরের তৈরি ঘর।

অগ্নিকাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন, পোড়া বস্তি ভেঙে সেখানে নতুন ঘর করে দেওয়া হবে। কিন্তু সরকারি টাকা কম আসায় সকলের ঘর পেতে দেরি হচ্ছে। পুজোর আগে সেখানে কয়েক জন ঘর পেতে পারেন বলে খবর।

এ দিকে, মাঠে প্লাস্টিক-ত্রিপলের নীচে দিন কাটাতে গিয়ে আলপনার প্রতিবেশীদের অনেকেই ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়ায় ভুগছেন। আলপনা ধীরে ধীরে বলেন, ‘‘রঞ্জিতার মা-ও জ্বরে ভুগছিল। হাসপাতাল জানিয়েছিল, ডেঙ্গি হয়েছে। সেখান থেকে ঘুরে আসার কয়েক দিনের মধ্যেই মলিনা মারা গেল। আঠারো আর কুড়ি বছরের দু’টি ছেলে রয়েছে মলিনার। তবে মাকে হারিয়ে বেশি অসহায় ১০ বছরের মেয়েটাই।’’

পুজোর গান আর আলোয় সাজছে তল্লাট। আপাতত দিনকয়েকের জন্য বিজ্ঞাপনী চমকে ঢেকে গিয়েছে মলিনাদের মলিনতা। লোকচক্ষুর আড়াল হচ্ছে নিবেদিতা উদ্যানের এক দিকে বাঁশের কাঠামোয় পর পর ত্রিপল টাঙানো ঘর। ঘর বলতে সাত বাই আট ফুটের খোপ। হাজার বস্তির বাসিন্দাদের ভাগের এক-একটি ঘর। প্লাস্টিকে মোড়া দেওয়াল। সেখানেই ঘুমোনো আর সেখানেই রান্না চলে। এমনই ঘরে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে থাকেন আলপনা। দিনের কাজ সারতে ব্যস্ত আলপনা বলেন, ‘‘তাড়াতাড়ি রান্না সেরে খেতে নিতে হবে। সব কাজ সারতে সারতেই বিকেল হয়ে যাবে। তার পরে ছুটতে হবে বাবুর বাড়ি। সব বাড়ি থেকে পুজোর বোনাস এখনও দেয়নি। যদি আজ পেয়ে যাই, তিনটেকেই নিয়ে যাব জামা কিনতে। ছোটটাকেই আগে কিনে দেব।’’

কিছু দূরেই অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে তখন খেলছে রঞ্জিতা। সে দিকে তাকিয়ে আলপনা বলে উঠলেন, ‘‘এ রকমই থাকুক। নিজের পায়ে না দাঁড়ালে অনেক অত্যাচার সহ্য করে যেতে হবে। যেমন আমায় করতে হয়েছে। তাই ও পড়াশোনা শিখবে। তা হলে নিজের দায়িত্ব নিজেই সামলাবে।’’

সরকারের দেওয়া ঘর কি পুজোর আগেই পাবেন আলপনারা? সেখানে কি আলো জ্বলবে? ‘অন্নপূর্ণা’ আলপনা মণ্ডল অবশ্য সে সবের প্রতীক্ষায় থেমে থাকেন না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement