একসঙ্গে: নতুন ঠিকানার পথে চার যুবক। —নিজস্ব চিত্র।
রোজ সকাল ৬টার মধ্যে ঘুম থেকে ওঠা। স্নান, পুজো সেরে অফিসে যাওয়া। ঘড়ি ধরে ওষুধ
খাওয়া। সারা দিনের খাবারের চিন্তা। নিজের মাসমাইনে থেকে সামান্য হলেও টাকা বাঁচানো। এ সব শুনতে যতটা সহজ, ততোধিক কঠিন ওঁদের কাছে। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে মানসিক রোগের চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফেরার এবং স্বাবলম্বী হওয়ার পাঠ নিচ্ছেন ওই চার যুবক। নানা কারণে পরিবারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ ওঁদের হয়নি।
ওঁরা কেউ থাকতেন পাভলভ, কেউ বা লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে। একই হাসপাতালের আবাসিক হলেও নিজেদের মধ্যে আগে দূরত্ব ছিল খানিকটা।
চিকিৎসার পরে মূল স্রোতে ফেরার চেষ্টায় সেই দূরত্ব ঘুচেছে খানিকটা দায়ে পড়েই।
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর, সমাজকল্যাণ দফতর এবং মানসিক রোগীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘অঞ্জলি’র সম্মিলিত প্রয়াসে ২০২২ সালে শুরু হয়েছিল জীবন সহায়তা কেন্দ্র ‘প্রত্যয়’। সুস্থ হয়ে ওঠা অনেক মানসিক রোগীকেই সেখানে রেখে এবং কাজের সন্ধান দিয়ে আত্মনির্ভর করেছে প্রত্যয়। ঠিক যে ভাবে তারা দাঁড়িয়েছিল প্রদীপ দাস, মদন বর্মণ, রাজু চৌধুরী ও প্রণব লাহিড়ীর পাশেও।
চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ওই চার যুবক কলকাতার কাঁটাপুকুরে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একসঙ্গে থাকছেন। ২০১৫ সালে প্রদীপের পরিবার তাঁকে পাভলভে ভর্তি করে। বর্তমানে শিয়ালদহের একটি ছাপাখানায় প্যাকিংয়ের কাজে যুক্ত প্রদীপ। ২০১৯ সালে লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হন রাজু। তিনিও বর্তমানে সুস্থ হয়ে নিরাপত্তারক্ষী হিসাবে কাজ করছেন। ২০২১ সালে লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে মদনকে রেখে যায় তাঁর পরিবার। রাজু এবং মদনের বাড়ি যথাক্রমে কসবা ও কাঁটাপুকুরে। অভিযোগ, পরিবার তাঁদের ফিরিয়ে নেয়নি। সেই মদন সল্টলেকের করুণাময়ীতে একটি অফিসে পিয়নের কাজ করছেন। বেলঘরিয়ার বাসিন্দা প্রণব লাহিড়ীকে কয়েক বছর আগে তাঁর পরিবার পাভলভে রেখে যায়। বাকি তিন জনের মতোই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে প্রত্যয়ের আবাসিক ছিলেন প্রণব। তিনিও এখন কাজ করছেন।
চার যুবকই জানালেন, রাতে ও দিনের বেলায় তাঁরা বাইরেই খেয়ে নেন। একসঙ্গে
থাকতে থাকতে পরস্পরকে সাহায্য করেন। যেমন, পাছে কাজে যেতে দেরি হয়, তাই মদনকে ঘুম থেকে সময় মতো তুলে দেন প্রণব। আবার প্রণবের পায়ে চোট লাগলে সাধ্যমতো সাহায্য করেন মদন। গরমে বেশি করে জল খাওয়ার কথা সকলকে মনে করিয়ে দেন প্রদীপ। আর্থিক অনটনে বেশি দূর পড়াশোনা হয়নি। সেই দুঃখ ভুলতে ‘ইংলিশ স্পিকিং কোর্স’-এর বই কিনে অবসর সময়ে পড়েন প্রদীপ।
মাসিক চার হাজার টাকা ভাড়ায় সকলে মিলেই পছন্দ করে নিয়েছেন ফ্ল্যাটটি। এই কাজেও পাশে থেকেছে প্রত্যয়। প্রত্যয়ের প্রজেক্ট কোঅর্ডিনেটর অভিজিৎ রায় বলেন, ‘‘এই মানুষগুলিকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরাতে গিয়ে দেখেছি, সমাজ এঁদের উপরেই নিজেদের প্রমাণ করার দায় চাপিয়ে দেয়। পাশে দাঁড়ানোর দায়বদ্ধতা সেখানে সীমিত। অথচ, এই মানুষগুলিই একে অন্যের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, যত্ন নিচ্ছেন। একসঙ্গে থাকতে থাকতে একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে ওঁদের। এটাই আমাদের প্রাপ্তি।’’
মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী রত্নাবলী রায় জানাচ্ছেন, মনোসামাজিক অসুস্থতা পেরিয়ে একার রোজগারে স্বাস্থ্যসম্মত মাথা গোঁজার জায়গা পাওয়া কঠিন। কয়েক জন মিলে একসঙ্গে থাকলে খরচটা ভাগ হয়ে যায়। যাঁরা একসঙ্গে থাকবেন, পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় যৌথ বসবাসের ব্যাপারে তাঁদের আস্থা ছিল কম। আর সেটাই ছিল চ্যালেঞ্জ। তাঁর কথায়, ‘‘ফলে এক ছাদের তলায় দল বেঁধে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দিগ্ধ ছিলাম আমরা। আবাসিকদের উপরেই নির্ভর করেছিলাম। একটা ভাবনা পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়াই আমাদের কাজ ছিল। বাকিটুকু তাঁরাই করেছেন। সমস্যা হলে নিজেরা কথা বলেছেন, কখনও ঝগড়াও করেছেন। ওঁরা যে নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন, সেটুকুই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল।’’