Trial

জেলে ৩৯ বছর, পঁচাত্তরের বৃদ্ধ এখনও ‘বিচারাধীন’

প্রশ্ন উঠেছে, উচ্চতর আদালত কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ নিয়ে মামলা করতে পারে? দীপক বা তাঁর আত্মীয়েরা কি ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন?

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ ও বিতান ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২০ ০৩:২১
Share:

ফাইল চিত্র।

জেলের কুঠুরির চার দেওয়ালের মধ্যেই নাকি কেটে গিয়েছে তাঁর ৩৯টা বছর! খোঁজ নেননি কেউ। এখন প্রায় ৭৫ বছর বয়সে পৌঁছে অবসাদে ঝুঁকে পড়েছে মাথা। দমদম কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে বন্দি সেই দীপক জোশী আবার বিদেশি। আদত বাড়ি নেপালে।

Advertisement

খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিলেন ১৯৮১ সালে, দার্জিলিঙে। কাকে খুন করেছিলেন, কেন খুন করেছিলেন, সেই দলিল-দস্তাবেজে এখন ধুলোর পুরু স্তর। প্রথমে দার্জিলিঙের জেল, সেখান থেকে আলিপুর হয়ে ২০০৫ সাল থেকে আছেন দমদম জেলে। অভিযোগ, আজও নাকি তিনি ‘বিচারাধীন বন্দি’। এখনও নাকি তাঁর সাজা হয়নি। নিজের বলতে কেউ নেই। তাই তাঁর হয়ে কোনও আইনজীবী আদালতে হাজির হন না। শুধু বদলে যায় শুনানির একের পর এক তারিখ। এই মামলায় সাক্ষীরও নাকি অভাব। তাই একের পর এক সহবন্দির মুক্তি চোখের সামনে দেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন অসহায় দীপক।

কারাগারের অন্তরালেই হয়তো রয়ে যেত এই কাহিনি, যদি না দীর্ঘ দিন জেল খাটার পরে সেখান থেকে বেরিয়ে মুখ খুলতেন রাধেশ্যাম দাস। নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া রাধেশ্যাম বহু দিন জেলে কাটিয়ে জামিনে বাইরে এসেছেন। গত প্রায় ১০ বছরের বেশি তিনি জেলে দীপকবাবুর সঙ্গে কাটিয়েছেন। তাঁর কথায়, “অসহায় ওই মানুষটার ভাষাও ঠিক করে কেউ বুঝতে পারেন না। নেপালি ভাষায় কী সব বলে যান। ইদানীং তো কথাই বন্ধ করে দিয়েছেন।” জেল থেকে বেরোনোর পরে কাকতালীয় ভাবেই রাধেশ্যামের সঙ্গে গত ১৬ অক্টোবর যোগাযোগ হয় পশ্চিমবঙ্গ রেডিয়ো ক্লাবের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাসের।

Advertisement

আরও পডুন: গলা ব্যথা নিয়ে মৃত্যুর ঘটনায় কমিশনে অভিযোগ​

আরও পডুন: করোনা কেড়েছে কালীপুজোয় উচ্চতার প্রতিযোগিতাও​

নেপাল দূতাবাস এবং রাজ্য কারা দফতরকে ইমেল করে ঘটনাটির কথা জানিয়েছেন অম্বরীশবাবু। এক দোভাষী নিয়ে দেখা করতে চেয়েছেন দীপকবাবুর সঙ্গে। অম্বরীশবাবুর কথায়, “আমাদের ক্লাবের সিনিয়র সদস্য হীরক সিংহ নিজে আইনজীবী। তিনিই প্রধান উদ্যোগী।”

কী বলছেন হীরকবাবু? ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে সতর্ক কন্ঠস্বর, “আমরা আপাতত সবটাই শোনা কথার উপরে ভিত্তি করে এগোচ্ছি। জেলে গিয়ে আগে রেকর্ড খতিয়ে দেখতে হবে। এত বছর ধরে সত্যিই যদি তিনি বিচারাধীন থাকেন, তা হলে তাঁকে কেন নিখরচায় আইনি সহায়তা দেওয়া হয়নি, উঠবে সেই প্রশ্ন। আর যদি খুনের অভিযোগে তাঁর যাবজ্জীবন সাজাও হয়ে যায়, তা হলেও বন্দির ভাল ব্যবহারের ভিত্তিতে এত দিনে তাঁর ছাড়া পেয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অন্তত জেল কর্তৃপক্ষের সরকারের কাছে তা নিয়ে আবেদন করার কথা ছিল।”

দমদম জেলে দীপক যখন একটু সুস্থ থাকতেন, তখন রাধেশ্যাম তাঁর কাছে গিয়ে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে আলাপ জমানোর চেষ্টা করতেন। তিনিই অম্বরীশবাবুকে জানিয়েছেন, দার্জিলিঙে থাকাকালীনই নাকি দীপকের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। মূলত সেই কারণেই তাঁকে কলকাতায় আনা হয়েছিল। নেপাল দূতাবাস মারফত দীপকের আত্মীয়দের খোঁজে নেমেছেন অম্বরীশবাবু। জানিয়েছেন, নেপালের ইলাম নামের কোনও এক জায়গায় তাঁর বাড়ি বলে দীপক রাধেশ্যামকে জানিয়েছেন। নেপাল দূতাবাসের কর্তারা সেখানে খোঁজ নিতে শুরু করেছেন। দীপক যে গ্রামের নাম বলেছিলেন, সেটির অবশ্য অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

অম্বরীশবাবু বলেন, “নেপালে আমাদের হ্যাম রেডিয়ো অপারেটরদেরও এই কাজে যুক্ত করা হয়েছে। আত্মীয়দের খুঁজে বার করতে পারলে দীপকের কাছে পৌঁছনোটা অনেক সহজ হবে।” আগামী ১৭ নভেম্বর কলকাতা হাইকোর্ট খুললে সেখানে দীপকের জামিনের আবেদন জানাতে পারেন হীরকবাবুরা। তার আগে অবশ্য দীপকের সঙ্গে কথা বলা দরকার। সেই সঙ্গে জেলের নথি দেখে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে, তিনি এখনও বিচারাধীন বন্দি। তবেই জামিনের আবেদন করা যাবে। সাজা হয়ে গিয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে আবেদন জানাতে উচ্চতর আদালতে যেতে হবে। নবান্নের এক কর্তা জানিয়েছেন, আইনজীবী আবেদন করলে দীপকের সঙ্গে দেখা করার ক্ষেত্রে কোনও বাধা থাকার কথা নয়।

প্রশ্ন উঠেছে, উচ্চতর আদালত কি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ নিয়ে মামলা করতে পারে? দীপক বা তাঁর আত্মীয়েরা কি ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন? মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা রঞ্জিত শূরের কথায়, “মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ এক চূড়ান্ত উদাহরণ। আমাদের দেশে বিনা বিচারে এ ভাবে জেল খাটার উদাহরণ অনেক। কিন্তু, ক্ষতিপূরণ পাওয়ার উদাহরণ নেই। তবে, হাইকোর্ট চাইলেই বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করতে পারে।” সে ক্ষেত্রে রাজ্য কারা দফতরের ব্যর্থতা প্রমাণিত হবে বলেই মনে করেন রঞ্জিতবাবু।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement