প্রতীকী ছবি
কোভিড বর্জ্যের বিপদ নিয়ে গত বছর থেকেই শোরগোল শুরু হয়েছে। পরিবেশকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের একাংশও তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমনকি, জাতীয় পরিবেশ আদালতেও কোভিড বর্জ্য নিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু তখনও রাজ্যে কোভিড বর্জ্যের বিপদের মাত্রা কতখানি, সেই চিত্র স্পষ্ট হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই বিপদ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল।
কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রকের তথ্য জানাচ্ছে, গত এক বছরে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩১ লক্ষ কিলোগ্রাম কোভিড বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে! কোভিড বর্জ্য উৎপাদনের নিরিখে রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে অষ্টম স্থানে। মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে উৎপন্ন হওয়া মোট কোভিড বর্জ্যের পরিমাণ ৩১২৮.৯ টন। অর্থাৎ, ৩১ লক্ষ ২৮ হাজার ৯০০ কিলোগ্রাম!’’
তবে এই পরিসংখ্যান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। যেমন সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘যত্রতত্র পড়ে থাকা কোভিড বর্জ্যও কি এই তথ্যের অন্তর্ভুক্ত? তা তো নয়। কোভিড রোগীর প্রকৃত সংখ্যার মতোই বর্জ্যের পরিমাণ নিয়েও ধন্দ রয়েছে।’’ ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর হসপিটাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট’-এর প্রেসিডেন্ট অশোক আগরওয়াল এ ক্ষেত্রে একটি প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছেন। তিনি জানাচ্ছেন, করোনা সংক্রমণের আগে বায়োমেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত যত সংখ্যক ‘কমন বায়োমেডিক্যাল ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট ফেসিলিটিজ়’ (সিবিডব্লিউটিএফ) পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশে কাজ করছিল, সেই ১৯৮টিই বর্তমানে কাজ করছে। অশোকবাবুর কথায়, ‘‘অর্থাৎ, বর্জ্যের পরিমাণ বাড়লেও সিবিডব্লিউটিএফ-এর সংখ্যা বাড়েনি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।’’
কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ সূত্রে আবার জানা যাচ্ছে, ২০১৭-’১৮, ২০১৮-’১৯ ও ২০১৯-’২০ সালে দেশে হাসপাতাল-সহ সমস্ত ধরনের স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রের (হেলথকেয়ার ফেসিলিটিজ় বা এইচসিএফ) সংখ্যা ছিল যথাক্রমে প্রায় আড়াই লক্ষ, ২ লক্ষ ৭০ হাজার এবং ৩ লক্ষ ২২ হাজার। সংক্রমণের কারণে কোভিড নির্দিষ্ট হাসপাতাল, কোভিড স্বাস্থ্যকেন্দ্র-সহ করোনা মোকাবিলার সার্বিক পরিকাঠামোর পরিসরই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, ২০২০-র সেপ্টেম্বরে প্রতি করোনা আক্রান্তপিছু উৎপন্ন হওয়া কোভিড বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ২.০৯ কিলোগ্রাম, সেখানে চলতি বছরের মে মাসে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৯০ গ্রাম!
এর কারণ ব্যাখ্যা করে পর্ষদের এক কর্তা বলছেন, ‘‘গত বছরের মতো চলতি বছরে কোভিড বর্জ্য অন্য কোনও রকম বর্জ্যের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে না। তার পৃথকীকরণ যথাযথ ভাবে হওয়ায় কোভিড পরিষেবা কেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও বর্জ্য সে ভাবে বাড়েনি।’’ যার পরিপ্রেক্ষিতে কোভিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খতিয়ে দেখার জন্য গত বছর রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ গঠিত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক নব দত্ত বলছেন, ‘‘এই সব ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে লাভ আছে? এ রাজ্যে কমিটি যত দিন নজরদারি করছিল, তত দিন তবু একটা চাপ ছিল। এখন তো নজরদারিই নেই! ফলে কোভিড বর্জ্য নিয়ে চূড়ান্ত নৈরাজ্য চলছে।’’
কোভিড বর্জ্য নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলার আবেদনকারী সুভাষ দত্ত আবার জানাচ্ছেন, তথ্যের এই অসঙ্গতি শুরু থেকেই ছিল। কোভিড বর্জ্যের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর জুলাইয়ে পরিবেশ আদালতে দেওয়া হলফনামায় রাজ্য সরকার জানিয়েছিল, বিভিন্ন হাসপাতাল ও পুর এলাকা থেকে গত বছরের জুন পর্যন্ত মোট ৩ লক্ষ ৮৪ হাজার ৫৪৭ কিলোগ্রাম কোভিড বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সুভাষবাবুর কথায়, ‘‘রাজ্যে এত কোভিড হাসপাতাল, এত কোয়রান্টিন কেন্দ্র থাকলেও বর্জ্যের পরিমাণ সব মিলিয়ে চার লক্ষ কিলোগ্রামও হয়নি! এটা কী করে সম্ভব হতে পারে? এ বারও সেটাই হয়েছে।’’
কেন্দ্রের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, কোভিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তথ্য সংগ্রহের জন্য তৈরি ‘কোভিড১৯বিএমডব্লিউ’ অ্যাপের মাধ্যমেই নিয়মিত সব তথ্য নথিভুক্ত করা হচ্ছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরও জানাচ্ছে, কোভিড বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। গত মে মাসেই রাজ্যের ছ’টি সিবিডব্লিউটিএফ-এর মধ্যে অধীনস্থ এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্বের পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে উদ্ভূত সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়েও রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম বলছেন, ‘‘সেগুলির দ্রুত সমাধানও করা হচ্ছে।’’