নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র
রাজ্য সরকারের প্রকল্প ‘দুয়ারে সরকার’ এবং ‘পাড়ায় সমাধান’ নিয়ে নিয়ে বিজেপি-সহ বিরোধীদের সমালোচনা সপাটে ওড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের মুখে এমন কর্মসূচি প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সাফ জবাব, ‘‘হঠাৎ করে নয়। ভোটের মুখেও নয়। তৃণমূল স্তরে অন্তত ৫০০টি প্রশাসনিক বৈঠকের পর এই পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমরা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে প্রথম থেকেই প্রশাসনিক বৈঠক করে মানুষের সমস্যার সমাধান করেছি। এখন সরকার পৌঁছচ্ছে মানুষের দরজায় দরজায়।’’ প্রসঙ্গত, বুধবার নবান্নে স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মহলের উপস্থিতিতে ‘দুয়ারে সরকার’ ও ‘পাড়ায় সমাধান’ প্রকল্পের সাফল্য তুলে ধরার অনুষ্ঠানে প্রশাসনিক আধিকারিকদের আরও ‘মানবিক’ হওয়ার আর্জি জানিয়েছেন মমতা। বলেছেন, ‘‘অনেক কাজ করেছেন। আরও করতে হবে। দেখবেন, আমরা যেন মানুষের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করি। এটা সকলকেই বলছি।’’
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, নবান্নের সভাঘরে মাটির দেওয়াল, খড়ের চালার একটি ঘরের দাওয়ায় বসে ওই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই দাওয়ার একপাশে তুলসিমঞ্চ। অন্যপাশে একটি গরুর মডেল। পাঁচিলের উপর রাখা হয়েছিল মুরগির মডেলও। অর্থাৎ, তাঁর সরকার যে গ্রামের মানুষের দরজায় দরজায় পৌঁছে তাঁদের হাতে প্রয়োজনীয় পরিষেবা তুলে দিচ্ছে, সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, এমন অভিনব পরিবেশ তৈরি করে রাজ্য সরকারের দু’টি ‘সফল’ প্রকল্পের তথ্য পরিসংখ্যান দেওয়ার পরিকল্পনাও মুখ্যমন্ত্রীর নিজেরই। অনুষ্ঠানের শুরুতে রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে-আসা কয়েকজনের হাতে পরিষেবা তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং।
কেন্দ্রের ‘আয়ূষ্মান ভারত’ চালু না করে রাজ্যে আলাদা ‘স্বাস্থ্যসাথী’ প্রকল্প আলাদা করা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি দিয়ে জানিয়েছেন, রাজ্যের সব মানুষকে চিকিৎসাবিমার সুবিধা দিতেই এই প্রকল্প। তাঁর কথায়, ‘‘সকলের জন্য বিনা ব্যয়ে স্বাস্থ্য পরিষেবার সুবিধার জন্যই এই প্রকল্প। আমি চাই, রাজ্যএর ১০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সুবিধা নিন।’’ তিনি কি মনে করেন, এই দু’টি প্রকল্প তাঁর অনুকূলে খেলা ঘুরিয়ে দেবে? মমতার জবাব, ‘‘খেলা ঘোরানোর তো কিছু নেই! এটা তো আমরা বরাবরই করে আসছি।’’
উপভোক্তাদের বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা তুলে দিচ্ছেন মুখ্য়মন্ত্রী। —নিজস্ব চিত্র
গত ১ ডিসেম্বর থেকে ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচিতে পাড়ায় পাড়ায় ক্যাম্প করে স্বাস্থ্যসাথী, খাদ্যসাথী, জাতি শংসাপত্রের মতো রাজ্য সরকারের মোট ১২টি প্রকল্পে সাধারণ মানুষের নাম নথিভুক্ত করছেন প্রশাসনিক আধিকারিকরা। তথ্যপ্রমাণ ও নথিপত্র যাচাই করে কয়েক দিনের মধ্যেই সেই সংক্রান্ত পরিষেবার জন্য নথিবদ্ধ হচ্ছেন নাগরিকরা। রাজ্যের হিসেবে পাঁচ দফার এই কর্মসূচিতে এখনও পর্যন্ত মোট নাম লিখিয়েছেন মোট ২ কোটি ৫৫ লক্ষ মানুষ। তার মধ্যে প্রায় ৭৭ শতাংশ উপভোক্তার হাতেই পরিষেবা তুলে দেওয়া হয়েছে বলে বুধবার জানান মুখ্যমন্ত্রী।
২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর জেলায় জেলায় প্রশাসনিক আধিকারিকদের নিয়ে গিয়ে পর্যালোচনা বৈঠকের অভিনব রীতি চালু করেছিলেন মমতা। সে কথাও তিনি বুধবার মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘‘আগে তো গ্রামের লোকদের এখানে ডেকে আনা হত। কিন্তু আমরাই প্রথম গ্রামের মানুষএর কাছএ গিয়েছি। প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্যের কোণায় কোণায় পরিষেবা প্রদানের বৈঠক করেছি।’’ প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক কালে কোভিড সংক্রমণের জন্য কয়েক মাস ছাড়া গত ১০ বছরে ওই বৈঠকে ছেদ পড়েনি। কিন্তু বিজেপি-সহ রাজ্যের বিরোধী দলগুলি অভিযোগ তুলেছে, ভোটের মুখে কেন নাগরিকদের দরজায় যাওয়ার প্রয়োজন পড়ল?
নবান্নের সভাঘরে সাংবাদিক বৈঠকে মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —নিজস্ব চিত্র
সেই সমালোচনা সপাটে উড়িয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘এক দিনে হঠাৎ করে এমন প্রকল্প চালু হয়নি। আমরাই কলকাতা থেকে জেলায় জেলায় প্রশাসন নিয়ে গিয়েছি। প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে আমি নিজে গিয়ে এলাকার মানুষের সমস্যা শুনেছি। সেগুলি সমাধানের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও কিছু মানুষ হয়তো বাদ পড়েছেন। তাঁদের হাতে সরকারি প্রকল্পের সুবিধা তুলে দিতেই এমন জনমুখী প্রকল্প।’’
দুয়ারে সরকার কর্মসূচির ১২টি প্রকল্পের মধ্যে বেশি মানুষ নাম লিখিয়েছেন ‘স্বাস্থ্যসাথী’-তে। এই প্রকল্পে প্রত্যেক পরিবারের জন্য ৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমা করিয়ে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। তার পুরো প্রিমিয়ামও রাজ্য সরকার দেবে। আগে এই প্রকল্প রাজ্যের একাংশের জন্য ছিল। ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচি থেকেই সবাইকে দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে। অন্য দিকে কেন্দ্রেরও প্রায় একই রকম প্রকল্প রয়েছে ‘আয়ূষ্মান ভারত’। বিরোধীদের অভিযোগ, ‘আয়ূষ্মান ভারত’ চালু না করে রাজ্যে আলাদা করে স্বাস্থ্যসাথী কেন করা হল? মমতার যুক্তি, ‘‘আয়ূষ্মান ভারতের প্রিমিয়ামের টাকার ৬০ শতাংশ কেন্দ্র দেয়। রাজ্যকে দিতে হয় ৪০ শতাংশ। কিন্তু সেই প্রকল্প শুধুমাত্র গরিব-নিম্নবিত্তদের জন্য। সবার জন্য নয়। রাজ্যের সব নাগরিক যাতে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় থাকেন, তার জন্যই এই বন্দোবস্ত।’’ এই প্রসঙ্গেই মমতা বলেন, ‘‘আমি খুশি হব যদি রাজ্যের ১০ কোটি মানুষই স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নেন।’’
শুধু কার্ড করিয়ে দেওয়া বা সরকারি প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া নয়, প্রশাসনিক আধিকারিকদের মানবিক হওয়ার আবেদনও করেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘জেলাশাসক, মহকুমা শাসক, বিডিও-রা খুব ভাল কাজ করেছেন। কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সব রকম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমি চাই আধিকারিকরা আরও মানবিক হয়ে আমজনতার পাশে দাঁড়ান।’’