আগুয়ান: সমাবেশে যোগ দিতে শিয়ালদহ থেকে মিছিল করে ধর্মতলার পথে। বৃহস্পতিবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী
সার দিয়ে দাঁড়িয়ে বাস, লরি, মোটরবাইক, ট্যাক্সি, জিপ। একঝলক দেখলে তীব্র যানজট বলে মনে হতে পারে! পরে অবশ্য বোঝা গেল, বৃহস্পতিবার ধর্মতলার সভা-মঞ্চের দিকে আসা সব গাড়ি তুলে দেওয়া হয়েছে বন্ধ থাকা পার্ক স্ট্রিট উড়ালপুলের উপরে। সেগুলি থেকে কোনও মতে নেমে সওয়ারিদের কেউ বাস বা লরির ছাদে চড়ে বসার চেষ্টা করছেন, কেউ উড়ালপুলের রেলিং ধরে ঝুঁকে সামনের দিকে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উড়ালপুলের নীচেও লোকের গাদাগাদি ভিড়। রেলিং ধরে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা থামিয়ে এক জন বলে উঠলেন, ‘‘আর গাড়ি যাবে না? দিদির স্টেজ কই? সামনে তো শুধুই কালো মাথা! মাথা দেখতে মালদহ থেকে এলাম নাকি?’’
করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে গত দু’বছরে শেষ কবে কোনও রাজনৈতিক সভা ঘিরে শহরের রাস্তায় এমন জনজোয়ার দেখা গিয়েছে, মনে করতে পারছেন না অনেকেই। শহরের বুক চিরে যাওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার হাজরা থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত সুবিশাল অংশ শেষ কবে দিনের ব্যস্ত সময়ে এমন অবরুদ্ধ থেকেছে, উত্তর মিলছে না সেই প্রশ্নেরও। বৃষ্টিতেও সেই ভিড়ে ভাটা পড়েনি।
এ দিন সভা-মঞ্চের দিকে মূলত হাওড়া, শিয়ালদহ, শ্যামবাজার, উল্টোডাঙা এবং হাজরা হয়ে মিছিল গিয়েছে। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ দক্ষিণ কলকাতার মূল মিছিলটি বেরোয় হাজরা মোড় থেকে। সেই মিছিলে ছিলেন কসবার গীতাঞ্জলি স্টেডিয়ামে থাকা মুর্শিদাবাদ এবং মালদহের লোকজন। কেউ পরেছিলেন তৃণমূলের পতাকার রঙের পোশাক, কেউ সারা গায়ে লিখিয়েছিলেন ‘মা মাটি মানুষ’! ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে থাকা পুরুলিয়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের লোক সভায় গিয়েছেন হাওড়া দিয়ে আসা মিছিলের সঙ্গে। শিয়ালদহ থেকে আসেন উত্তর ২৪ পরগনা এবং উত্তরের বিভিন্ন জেলার লোক। সেখানেই দেখা গিয়েছে পোস্টার, ‘ডাক দিচ্ছে জনতা, দিল্লি যাবেন মমতা’। উত্তর কলকাতার মিছিল আবার গিয়েছে দু’ভাগে, রবীন্দ্র সরণি এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ হয়ে।
রাস্তার জায়গায় জায়গায় লাগানো হয়েছিল বড় পর্দা। সভার উদ্যোক্তারা একরকম ধরেই নিয়েছিলেন, এ বার এত লোক হবে যে, সভা-মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন না অনেকে। দেখা গেল, এক-একটি জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে কয়েক হাজার করে লোকের ভিড়। দক্ষিণ কলকাতা থেকে আসা মিছিলের লোকজনকে বৃষ্টিতে মাথা বাঁচাতেদেখা গেল পার্ক স্ট্রিট উড়ালপুলের নীচে। গিরিশ পার্কের কাছে জায়ান্ট স্ক্রিনে চোখ রাখা বারাসতের রাজু পাণ্ডে হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘খামোস!’ পর্দায় দেখাচ্ছে, সেই সময়ে বক্তৃতা করতে উঠছেন শত্রুঘ্ন সিংহ। তাঁরই সিনেমার ডায়ালগ শুনে, উঠল হাসির রোল। চাঁদনি চকের কাছে সন্তান কোলে এক তরুণীকে আবার বলতে শোনা গেল, ‘‘নেতাদেরকথা কম হয়ে একটু নাচ-গান দেখালে ভাল হয়।’’
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের কাছে একটি গলির রাস্তায় বাস থামিয়ে খাওয়া শুরু করা এক ব্যক্তি মাইক দেখিয়ে বললেন, ‘‘দিদির কথা তো কানে পৌঁছবে ঠিকই। কিন্তু এখনই না খেলে পেটে আর খাবার যাবে না। আমাদের বাস কিছু ক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে।’’ এমনই একটি বাসের লোকজনকে আবার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল, চিড়িয়াখানায় ঘুরতে যাওয়া তাঁদের সঙ্গীর জন্য। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ জওহরলাল নেহরু রোড ধরে সভামঞ্চের উল্টো দিকে হাঁটতে থাকা ভিড়টা থেকে এক মহিলা বলে উঠলেন, ‘‘দু’দিন ধরে ভালই কলকাতা ঘুরলাম।’’ সবে তো দলনেত্রী বক্তৃতা করতে উঠেছেন। শুনবেন না? পাশে দাঁড়ানো একনেতা মহিলাকে থামিয়ে বললেন, ‘‘নেতারা দিদির বার্তা পরে সকলকে বুঝিয়ে দেবেন।’’