সেরা: গোষ্ঠ পাল
বড়রা যেমন খবরের কাগজটি সযত্নে পরিপাটি ভাঁজ করে নিয়ে গুছিয়ে খবর পড়ে, ছোটদের তেমন নয় মোটেই। তারা সেটা মেঝেতে বিছিয়ে নিয়ে তার উপর চতুষ্পদের মতো ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করে। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো তা-ই হত। জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখে আসছি, বাড়িতে রোজ আসে আনন্দবাজার পত্রিকা, যে প্রথা আজ অবধি বজায় আছে। আর নিয়মিত আসত সচিত্র ভারত আর শনিবারের চিঠি। আনন্দবাজার পত্রিকা তার জন্মলগ্ন থেকেই মুখোপাধ্যায় পরিবারের অন্দরমহলে ঢুকে বসে আছে। একশো বছরের সম্পর্ক, সোজা কথা নয়।
খবরের কাগজ পড়ার বা বোঝার বয়স তখনও হয়নি, তবে মাঝে মাঝে কৌতূহলের বশে বাঘের মতো খাপ পেতে বসে খবরের কাগজে যুদ্ধের ছবি দেখতাম। তখন কাগজে ভুসো কালিতে ছাপা ছবি তেমন বোঝাও যেত না। তবে সৈন্যদের মৃতদেহ শনাক্ত করা যেত। ভাঙা এরোপ্লেন বা ধ্বংসস্তূপ বোঝা যেত।
বাবা খেলোয়াড় হওয়ার সুবাদে খুব অল্প বয়স থেকেই ক্রিকেট, ফুটবল, হকি বা টেনিস বুঝতে পারি। আর জো লুইয়ের সুবাদে বক্সিংও চুম্বকের মতো টানে। জো লুইয়ের ছবি প্রায়ই খবরের কাগজে বেরোয়। ওত পাতা কোলকুঁজো, দু’টি গ্লাভস আঁটা হাত শরীরের দু’দিকে, মাথা নেড়া জো লুইয়ের সেই ছবি দেখে আশ যেন মিটত না। তিনি সর্বদাই জয়ী, লড়াই হলেই জো জিতবেন, এটাই যেন নিয়ম। যেমন ব্র্যাডম্যান মাঠে নামলেই সেঞ্চুরি। হ্যাঁ, তখন ব্র্যাডম্যানের নামও মুখে মুখে। আর গোষ্ঠ পাল। কাগজে আরও অনেক পাতা থাকে, সম্পাদকীয়, আইন-আদালত, সিনেমা-থিয়েটার, রাজনীতি। আমার শুধু খেলার পাতা আর সপ্তাহে এক দিন আনন্দমেলা।
তখন রেডিয়ো নেই, টেলিভিশন নেই, ধারাবিবরণী নেই, কবে কার সঙ্গে কার খেলা, তা-ও জানা থাকত না। শুধু খবরের কাগজ, অর্থাৎ আনন্দবাজার সম্বল। বাবা কাঠবাঙাল হওয়া সত্ত্বেও মোহনবাগানের ভক্ত। ইস্টবেঙ্গল নামে একটা নতুন ক্লাবের উদ্ভব হওয়া সত্ত্বেও বাবা চিরকাল মোহনবাগানের পক্ষেই রয়ে গেলেন। ক্লাবটা হেরে গেলে বাবাকে খুব বিরক্ত হতে দেখতাম, আপন মনেই নিচু গলায় বলতেন, “যাইচ্ছাতাই, যাইচ্ছাতাই, অপদার্থগুলি কোনও কম্মের না!” হাতের খবরের কাগজটা ফটাস করে নিক্ষেপ করতেন সেন্টার টেবিলে।
তখন আমি জলপাইগুড়িতে আমার জেঠতুতো বড়দার বাসায় থেকে ফণীন্দ্রদেব ইনস্টিটিউশনে পড়ি। কাগজের আর সব ছেড়ে দিয়ে শুধু খেলার পাতাটাই মন দিয়ে পড়ি। জো লুই হওয়ার স্বপ্নে আমি বিভোর। আর তা হতে গিয়ে দেওয়ালে ঘুসি মেরে মেরে কত বার যে রক্তাক্ত হয়েছি, তার হিসেব নেই। তবে তখন জো-র জায়গা দখল করতে উঠে আসছেন নানা মুষ্টিক। তখন আনন্দবাজারে হঠাৎ জো উডকক আর লি স্যাভোল্ড-এর লড়াই নিয়ে তীব্র উত্তেজনা সঞ্চারিত হয়েছিল। আর কোনও বাংলা কাগজ এ সব খবরকে গুরুত্ব দিত না, আনন্দবাজার দিত। পাশাপাশি দু’জনেরই ছবি ছাপা হয়েছিল। দু’জনের মধ্যে উডককের চেহারাটাই আমার পছন্দ হল, মনে মনে তাঁরই সমর্থক হয়ে উঠলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, লড়াইটা তিনি শেষ পর্যন্ত হেরে যান, জয়ী হন স্যাভোল্ড।
১৯৭২ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু, রাশিয়ার বরিস স্প্যাস্কির সঙ্গে আমেরিকান চ্যালেঞ্জার ববি ফিশার-এর লড়াইকে আনন্দবাজার এমন উত্তুঙ্গ উত্তেজনার শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল যে, দাবা সম্পর্কে যারা কিছুই জানত না, তারাও পাইকারি হারে দাবার বোর্ড কিনে বসে গেল ব্যাপারটা অনুধাবন করতে। দাবা নিয়ে ইতিপূর্বে এ দেশে কারও তেমন আগ্রহ লক্ষ করিনি। দাবার সেই ঐতিহাসিক লড়াইয়ের যে রিপোর্ট প্রতিদিন আনন্দবাজারে বেরোত, তা রহস্য-কাহিনিকেও হার মানায়। খেলার খবরকে যে শুধু পিছনের পাতায় আটকে রাখলে চলবে না, সেটা প্রথম বুঝেছিল আনন্দবাজার। তাই গুরুত্বপূর্ণ খেলার প্রতিবেদন অনেক সময়েই রাজনৈতিক খবরকে সরিয়ে হেডলাইন হয়ে উঠতে লাগল প্রথম পাতায়। ব্যাপারটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল।
এক জন সাহিত্যিককে হঠাৎ ক্রীড়া সাংবাদিক করে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! বুকের পাটা লাগে এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে। আনন্দবাজার পত্রিকা সেটাই করেছিল মতি নন্দীকে। আমাদের সমসাময়িক এই শক্তিমান সাহিত্যকার কিন্তু ক্রীড়া সাংবাদিকতাতেও সমান সফল। ১৯৭৬ সালে আনন্দবাজার আমাকে সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ করার পরে আমার ক্রীড়াপ্রীতির জন্য বেশ কয়েক জন স্পোর্টস রিপোর্টার আমার অন্তরঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। স্পোর্টসে এক প্রবীণ সাংবাদিককে নিয়ে গৌরকিশোর ঘোষ প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদার আদলে ‘ব্রজদা’ চরিত্রটি সৃষ্টি করেছিলেন। আনন্দবাজারের খেলার প্রতিবেদনগুলিকে এঁরা যে উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন, তা তুলনাবিহীন।
আমার দফতরে প্রায়ই এসে হানা দিত মতি, বিশেষ করে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলা থাকলে। মতি মোহনবাগানের পক্ষে, আমি ইস্টবেঙ্গল। ফলে নানা রঙ্গরসিকতা হত। আর আসতেন পুষ্পেন সরকার। তিনি ছিলেন রেডিয়োয় ফুটবলের ধারাভাষ্যকারও। তাঁর সঙ্গে আমার বিস্তর আড্ডা হত। তিনি ছিলেন প্রচ্ছন্ন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। হিমানীশ গোস্বামী স্পোর্টস রিপোর্টার ছিলেন না, তবে দাবা খেলার রিপোর্ট তাঁকে দিয়েই লেখানো হত, দাবা নিয়ে তাঁর ব্যাপক চর্চার জন্য।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উত্থান এবং লর্ডসে প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরির অনবদ্য প্রতিবেদনটি ভোলার নয়। যে কোনও ক্ষেত্রেই হোক, বাঙালির কৃতিত্বের কথা আনন্দবাজার ফলাও করে লিখতে ছাড়ে না। সেটা ১৯৫৯ সাল। ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে স্ট্যাথাম আর ট্রুম্যানের ফাস্ট বোলিং-এ নাজেহাল হচ্ছে ভারত। উমরিগড় অবধি ক্রিজ় ছেড়ে পালিয়েছিলেন। এ দিকে হেলমেটহীন, চেস্টগার্ডহীন, এলবো-গার্ডহীন আমলে চশমা পরিহিত পঙ্কজ রায় কিন্তু গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেও একটি ধৈর্যশীল ইনিংস খেলেছিলেন। রান আউট হয়ে যান বটে, কিন্তু ইংরেজ সাংবাদিকরাও বাহবা দিয়েছিলেন বাঙালি ব্যাটসম্যানের সেই সাহসী ইনিংসের। আর পঙ্কজের খেলার যে রিপোর্টটি আনন্দবাজারে বেরিয়েছিল, তা ছিল মর্মস্পর্শী। সাহিত্য ও শিল্পবোধ ছাড়া অমন ক্রীড়া সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। আর হবে না-ই বা কেন, আনন্দবাজার সেই কবে থেকে বাংলার সেরা সাহিত্যকারদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানে শামিল করে নিয়েছিল।
কে না জানে, সাহিত্য ও সাহিত্যকারদের প্রতি পক্ষপাত আনন্দবাজারকে কত সমৃদ্ধ করেছে। আর তাই বোধ হয় সাহিত্যের হাওয়া বার বার ক্রীড়ার মেঠো সংবাদেও সঞ্চারিত হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকার একশো বছরের ইতিহাসে ক্রীড়া সাংবাদিকতাও তাই একটা দিকচিহ্ন হিসেবে বলবৎ থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।