শীতের পোশাকে বাড়ি থেকে বার হলেও, মাঝরাস্তায় তা খুলে ফেলতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কত দিন? ছবি: সংগৃহীত।
রাজ্যের অভিযোগ, তাদের বকেয়া টাকা দিনের পর দিন আটকে রাখছে দিল্লি। এ বার কি রাজ্যের শীতের বরাদ্দেও দিল্লি ভাগ বসাতে চাইছে? আবহাওয়ার রকমসকম দেখে এমনটা মনে হলে দোষের কিছু নেই কিন্তু।
সত্যিই তো দিল্লি যখন শীতে জবুথবু, তখন কলকাতায় কেন গরম জামা গায়ে রাখা যাচ্ছে না? যে উত্তুরে হাওয়া দিল্লি এই তল্লাটে পাঠায়, তা মধ্যপ্রদেশ-ছত্তীসগঢ়ে এসেই কেন মুখ থুবড়ে পড়ছে? পৌষ মাসে খেজুরের রস, পাটালি, নলেন গুড়, কড়াইশুটি সব হাজির। নেই শুধু শীতটাই। বড়দিনের রাতে যাঁরা আপাদমস্তক ঢেকে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন, তাঁদের নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে। কচিকাঁচাদের অনেকেই ঘেমে নেয়ে একশা। এ সময়ে সর্দি-কাশি স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই বলে কি না এই ভরা পৌষে ঘাম বসে গিয়ে শরীর বিকল! এটা কিন্তু মানা যাচ্ছে না। এ সব আসলে প্রকৃতির খেয়াল। প্রকৃতিকে এ ভাবে খামখেয়ালি বানিয়েছে অবশ্য মানুষই। সে অন্য গল্প।
এ বার বর্ষায় বাংলায় বৃষ্টির বরাদ্দ পুরো মেটেনি। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা, তখন আকাশে বাদল মেঘের দেখা মেলেনি। বীজধান নষ্ট হয়েছে মাঠেই। কারণ মৌসুমি জোরদার হওয়ার জন্য যে সব প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ড দরকার হয়, সেগুলি যথাযথ ছিল না। বর্ষার পরে এ বার শীতের মুখেও কেন আগল তুলে দিল প্রকৃতি?
মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) সকালে দিল্লি ছিল এমনই। দেশের রাজধানীর তাপমাত্রা এখন নৈনিতালের থেকে কম। ছবি: পিটিআই।
আবহবিদেরা কী বলছেন এক বার দেখা যাক। যে উত্তুরে হাওয়ার জন্য দিল্লিতে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি চলে এসেছে, মধ্যপ্রদেশে তাপমাত্রা চার ডিগ্রির নীচে নেমে গিয়েছে, স্কুল-কলেজ সব ছুটি, কিন্তু শীত এক্সপ্রেস কেন ছাড়তে পারছে না মধ্যপ্রদেশ? এক আবহবিদের কথায়, ‘‘সিগন্যাল পাচ্ছে না তাই। অনুকূল পরিস্থিতি এলেই সিগন্যাল সবুজ হবে।’’ গাঙ্গেয় উপত্যকায় তৈরি হয়েছে একটি উচ্চচাপ বলয় বা বিপরীত ঘূর্ণাবর্ত। যা বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প এনে জমা করছে কলকাতার বায়ুমণ্ডলে। ওই জলীয় বাষ্পই শীত এক্সপ্রেসের সিগন্যাল ডাউন হতে দিচ্ছে না, মন্তব্য ওই আবহবিদের। পশ্চিমবঙ্গের আকাশে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ না কমলে সিগন্যাল সবুজ হবে না।
দেখা যাক, এই উচ্চচাপ বলয় বা বিপরীত ঘূর্ণাবর্তটি তৈরি হল কী ভাবে। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের উপদেষ্টা এবং আবহবিদ গোকুলচন্দ্র দেবনাথের ব্যাখ্যা, শ্রীলঙ্কার কাছে তৈরি হওয়া একটি শক্তিশালী নিম্নচাপই এর জন্য অনেকটা দায়ী। কারণ ওই নিম্নচাপ থেকে তৈরি হওয়া একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা বঙ্গোপসাগর হয়ে গাঙ্গেয় উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। ওই নিম্নচাপ অক্ষরেখাই গোটা পূর্ব ভারত এবং সংলগ্ন বাংলাদেশের উপরে একটি উচ্চচাপ বলয় বা বিপরীত ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করেছে। যা বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্প টেনে আনছে। কলকাতা-সহ রাজ্যের সর্বত্র সকালের দিকে যে ঘন কুয়াশা পড়ছে তার কারণও ওই জলীয় বাষ্প। ভোরের দিকে যখন তাপমাত্রা অনেকটা কমছে, ওই জলীয় বাষ্প কুয়াশায় রূপান্তরিত হয়ে মাটির কাছাকাছি নেমে আসছে। আবার সূর্য ওঠার পরে জলীয় বাতাস উপরের পরিমণ্ডলে উঠে যাচ্ছে এবং উত্তুরে বাতাসের যাত্রাপথে পাঁচিল তুলে দিচ্ছে। শীত আটকে যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কার কাছে নিম্নচাপটি দুর্বল হলেই একমাত্র এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে এবং শীতের রাস্তা খুলে যাবে।
বড়দিনের বিকেলে কলকাতার ময়দান। সব রয়েছে, শুধু শীত নেই। ছবি: শাটারস্টক।
আবহবিদদের কেউ কেউ আবার উচ্চচাপ বলয়ের সঙ্গে অন্য একটি কারণকেও আনছেন। তাদের ব্যাখ্যা, এ বার নভেম্বর মাসে একেবারেই বৃষ্টি না হওয়াটা ডিসেম্বরে কম শীত পড়ার অন্যতম কারণ। কেন? এক আবহবিদের ব্যাখ্যা, সচরাচর নভেম্বর মাসে বৃষ্টি হলে তাতে পরিমণ্ডলে জমে থাকা জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কমে যায়। তাই উত্তরের হাওয়া বিনা-বাধায় পূর্ব ভারতে ঢুকে পড়তে পারে। আকাশে মেঘ না থাকলে আবহাওয়া এমনিতেই ঠান্ডা থাকে। কিন্তু এ বার বৃষ্টিহীন ছিল গোটা নভেম্বর মাস। তাই বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ আগে থেকেই বেশি ছিল। সে কারণে উচ্চচাপ বলয়ের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
ওই উচ্চচাপ বলয় সরবে কী ভাবে? শীত না থাকায় বড়দিনের মজাটা ঠিক জমেনি। কী হবে বর্ষশেষের রাতে? বর্ষশেষের কড়া শীতে রাতে আগুন জ্বালিয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানানোর পরিকল্পনা করেছিলেন অনেকে। কিন্তু ‘গরম’ কি সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দেবে? আবহবিদেরা কিন্তু মুষড়ে পড়তে নিষেধ করছেন। তাঁদের আশা, চাকা এই ঘুরল বলে! কারণ, আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই উত্তুরে হাওয়ার দাপটে সরে যাবে ‘ভিলেন’ উচ্চচাপ বলয়। নতুন বছরেই কলকাতা তথা বাংলা তার ভাগের শীতটা পাবে। প্রকৃতির বঞ্চনা ঘুচবে। বুধবারের পরেই শীতের আমেজ ফিরবে বলে আশা করছেন আবহবিদেরা।
বড়দিনের দুপুরে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার এলাকা। ছবি: পিটিআই।
কতটা শীত পড়তে পারে বৃহস্পতিবার থেকে? আবহবিদ গোকুলচন্দ্র দেবনাথ জানাচ্ছেন, শ্রীলঙ্কার কাছে থাকা নিম্নচাপটি খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই দুর্বল হচ্ছে উচ্চচাপ বলয়ও। ঝাড়খণ্ডে তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। এ বার কমবে বিহার আর পশ্চিমবঙ্গে। মঙ্গলবার কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। এ সময় তা থাকা উচিত ১৪ ডিগ্রি। অর্থাৎ সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গোকুলবাবু জানাচ্ছেন, বৃহস্পতি বা শুক্রবার কলকাতার তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রির আশেপাশে চলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, উচ্চচাপ বলয় সরলেই মধ্যপ্রদেশে শীত এক্সপ্রেসের সিগন্যাল সবুজ হয়ে যাবে। গাঙ্গেয় উপত্যকায় হু-হু করে ঢুকে পড়বে কনকনে উত্তুরে বাতাস।
কিন্তু সেই শীতটা থাকবে ক’দিন? পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত ব্যাট করবে কি? আবহবিদেরা অবশ্য সেই ভবিষ্যৎবাণী করতে পারছেন না। কারণ, উপগ্রহ চিত্র দেখাচ্ছে, পাকিস্তানের কাছে ইতিমধ্যেই একটি পশ্চিমি ঝঞ্ঝা এসে অপেক্ষা করছে। কাশ্মীর, উত্তর ভারত হয়ে সে যখন গাঙ্গেয় উপত্যকায় ঢুকবে তখন আর এক দফা জলীয় বাষ্প ঢুকবে পরিমণ্ডলে। আবার বাধা পাবে উত্তুরে হাওয়া। তবে এখনই নির্ঘন্ট সঠিক ভাবে বলতে পারছে না হাওয়া অফিস।
আসলে একটি করে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা আসবে, আবার চলেও যাবে। তার সঙ্গে তাপমাত্রা ওঠানামা করবে। এটাই শীতের স্বাভাবিক ছন্দ। এই ছন্দপতন ঘটাতে পারে কোনও নিম্নচাপ বা উচ্চচাপ বলয়। এখন যা চুরি করেছে শীতকে।