—প্রতীকী চিত্র।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, অস্ত্রোপচারের (সিজ়ার) মাধ্যমে শিশুর জন্ম মা অথবা সন্তান, কারও স্বাস্থ্যের পক্ষেই নিরাপদ নয়। তাই মোট শিশুর জন্মের ১০-১৫ শতাংশের বেশি ক্ষেত্রে সিজ়ার কাম্য নয়। অথচ চলতি বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে মোট প্রসবের ৫০ শতাংশেরও বেশি ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারে জন্ম হচ্ছে শিশুর! যা দেখে চিন্তিত স্বাস্থ্যকর্তাদের একটি অংশ।
শিশুরোগ চিকিৎসকদের মতে, গর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কে প্রতি মিনিটে প্রায় ২৫ হাজার নিউরোন তৈরি হয়। ফলে সময়ের আগে অস্ত্রোপচার করলে ধাক্কা খায় মস্তিষ্কের পূর্ণ বিকাশ। শুধু তা-ই নয়, মায়ের শরীরের পক্ষেও ক্ষতিকর সিজ়ার। অথচ অধিকাংশ মা প্রসবকালীন যন্ত্রণা এড়াতে অস্ত্রোপচারের পথই স্বচ্ছন্দ মনে করেন। ডাক্তারদের মতে, উপযুক্ত পরিবেশ এবং মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য না পেলেই মায়েদের প্রসবযন্ত্রণা বেশি হয়। কিন্তু তা যথাযথ পেলে মায়ের মস্তিষ্ক থেকে অক্সিটোসিন হরমোন ক্ষরণ হয়। যা অল্প যন্ত্রণায় স্বাভাবিক প্রসবে সাহায্য করে।
সরকারি পরিকাঠামোয় এমন উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে গত ৯ অক্টোবর ‘সুমন’ প্রকল্প চালু করেছে কেন্দ্র। প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য, হাসপাতালে প্রসবের সময়ে মায়ের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় তাঁর জন্য একান্ত পরিসরের ব্যবস্থা করা। মায়ের যত্ন নেওয়া। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই গুজরাতের একাধিক সরকারি হাসপাতালে ‘সুমন’ প্রকল্প চালু হয়েছে। তার আওতায় কয়েক জন মায়ের যন্ত্রণাহীন স্বাভাবিক প্রসবও হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্প কবে চালু হবে, বলতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্তারা। অথচ অন্য রাজ্যের সঙ্গে এখানকার স্বাস্থ্যকর্তারাও দিল্লিতে এই সংক্রান্ত কর্মশালায় যোগ দিয়ে এসেছেন।
কোথায় কত
হাসপাতাল মোট প্রসব সিজ়ার শতকরা হার
• কলকাতা মেডিক্যাল ১২,৬০০ ৬৪০৭ ৫০
• এন আর এস ৭৮৭৭ ৪১৯৪ ৫৩
• আর জি কর ১৫,৩৯৪ ৮৯১৮ ৫৭
• ন্যাশনাল মেডিক্যাল ১১,৬৯২ ৫৯৮৮ ৫১
• এসএসকেএম ৫৯৯৩ ৩৬৮৩ ৬৭
• চিত্তরঞ্জন শিশু সদন ৯৯৪৩ ৫০০৬ ৫১
• অবিনাশ দত্ত মাতৃসদন ১৪৭২ ১০৭৭ ৯০
তথ্যকাল: এপ্রিল-অক্টোবর ২০১৯ | সূত্র: রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর
স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রের খবর, গত ১২ বছরে এ দেশে সরকারি হাসপাতালে সিজ়ারের সংখ্যা এক লাফে বেড়েছে ৩০০ শতাংশ। বেসরকারি হাসপাতালে সেই হার শতকরা ৪০০। সব চেয়ে খারাপ অবস্থা কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল, মহারাষ্ট্রে। ওই রাজ্যগুলির মতো না হলেও পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও কিন্তু বেশ খারাপ, বলছে তথ্য।
সে ক্ষেত্রে প্রকল্প চালু করতে রাজ্যের এই অনীহা কেন?
রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের একটি সূত্রের মত, সম্ভবত কেন্দ্র-রাজ্য ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক টানাপড়েন এর অন্যতম কারণ। দফতরের অন্দরের খবর, স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ‘রাষ্ট্রীয় বাল স্বাস্থ্য কার্যক্রমের’ জাতীয় উপদেষ্টা, চিকিৎসক অরুণ সিংহের তত্ত্বাবধানে চালু হয়েছে এই ‘সুমন’ প্রকল্প। সেই জন্যেও পশ্চিমবঙ্গ এ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কারণ, স্বাস্থ্যকর্তাদের কয়েক জনের সঙ্গে তিক্ততার জেরে এ রাজ্য ছেড়েছিলেন অরুণবাবু। যদিও রাজ্যের পরিস্থিতি সামলাতে মা ও শিশুমৃত্যুর অডিটের মতোই ‘সিজার কেস অডিট’ শুরু করতে চলেছে স্বাস্থ্য দফতর। কিছু দিনের মধ্যেই সেই সংক্রান্ত প্রশাসনিক কাজ শুরু হবে বলে জানা গিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় প্রকল্প গ্রহণ করার মতো পরিকাঠামো তৈরি হয়নি রাজ্যে। যে সব হাসপাতাল অহেতুক সিজ়ার করছে, তাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে (কেস-টু-কেস) জবাবদিহি করতে হবে। তাই শুরু হচ্ছে সিজ়ার অডিট। কেন, কোন পরিস্থিতিতে সিজ়ার হল তার ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে দিতে হবে। অকারণে সিজ়ার করা হলে শাস্তি পেতে হবে।’’
যা শুনে অরুণবাবুর বক্তব্য, ‘‘এ ভাবে সিজ়ার আটকানো যাবে না। কারণ চিকিৎসকেরা জানাবেন, স্বাভাবিক প্রসব বাধা পাচ্ছিল বলেই সিজ়ার হয়েছে। যা কিন্তু মিথ্যা নয়। কারণ সরকারি হাসপাতালের খারাপ লেবার রুম, নেতিবাচক পরিবেশে অনেক প্রসূতির ‘অবস্ট্রাক্টিভ লেবার’ হয়। প্রসূতি মায়েদের সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে চিকিৎসক এবং নার্সদের দুর্ব্যবহার আরও খারাপ করে তোলে পরিস্থিতি। নতুন প্রকল্প গ্রহণ করে এ সবের সমাধান করলে তবেই সিজ়ার কমবে।’’