আর জি কর-কাণ্ডের বিচার চেয়ে প্রতিবাদ। ছবি: পিটিআই।
এক বার তৎকালীন অধ্যক্ষের ঘরে, তো এক বার তৎকালীন সুপারের ঘরে। এক বার সেমিনার রুমের সামনে, তো এক বার সেমিনার রুমের ভিতরেই। সূত্রের দাবি, দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে তখন, কিন্তু কী করা হবে, তা ঠিক করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রেই জানা গিয়েছে, ঘনঘন ফোন বাজছে পুলিশের বড় কর্তাদের, জানাতে হচ্ছে ‘স্টেটাস রিপোর্ট’। জানা গিয়েছে, যা যা নির্দেশ আসছে সেই মতো কাজ হচ্ছে কি না, দেখে দিতে হচ্ছে প্রত্যুত্তরও।
প্রশ্ন উঠেছে, এর মধ্যেই কি তদন্তের প্রাথমিক নিয়মকানুন কিছুটা গুলিয়ে গিয়েছিল? তাই কি পুলিশের খেয়ালই ছিল না, যে সকাল ১০টা ১০ মিনিটে টালা থানায় লিখে বেরোনো ‘জেনারেল ডায়েরি’র ভিত্তিতেই দিনভর চলছে আর জি কর-কাণ্ডের সমস্ত তদন্ত? নাকি এর পিছনে রয়ে গিয়েছে অন্য কোনও রহস্য? আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের অভিযোগ, আদতে ঘটনা ধামাচাপা দিতে গিয়ে পুলিশ সময় গুলিয়ে ফেলেছে। কোন তথ্য-প্রমাণ রাখা হবে, আর কোনটা নয়, সেই হিসাব কষতে গিয়েই সব গুলিয়ে গিয়েছে। তাই এখন আর মেলাতে পারা যাচ্ছে না তদন্তের ‘সময় সারণি’। হাই কোর্ট প্রশ্ন তোলার পরে এই নিয়েই এখন পুলিশকে তুলোধোনার মুখে পড়তে হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টেও।
মৃতদেহ উদ্ধারের পর থেকে সে দিন কী কী ঘটেছিল আর জি করে?
বেলা ১০টা ১০ মিনিটে প্রথম টালা থানায় একটি ‘জেনারেল ডায়েরি’ লেখা হয়। নিয়ম মেনে থানার যে কোনও কাজ এই ভাবে ডায়েরিতে লিখে রাখার কথা। কিন্তু তার অনেক আগেই আর জি করের পুলিশ ফাঁড়িতে মৃতদেহ উদ্ধারের খবর চলে এসেছে। থানা থেকে আগের রাতে ডিউটিতে থাকা এক পুলিশকর্মীকে পাঠানো হয় ‘কেস ডায়েরি’ হাতে। ওই পুলিশ বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ ফাঁড়ির অফিসারকে নিয়ে ঘটনাস্থল, অর্থাৎ জরুরি বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলের সেমিনার রুমে যান। এক পুলিশকর্মীর দাবি, “বেলা সাড়ে ১০টায় পৌঁছে গেলেও বেলা ১১টা পর্যন্ত মৃতদেহ দেখে সিনিয়রদের খবরাখবর দেওয়া ছাড়া কিছুই করার ছিল না। সেমিনার রুমের সামনে তখন হাসপাতালের কর্তাদের ভিড়।” বেলা ১১টা নাগাদ ঘটনাস্থলে গেলেও লালবাজারের হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারা দীর্ঘক্ষণ নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরুই করতে পারেননি। সে দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক ডাক্তারের দাবি, “নতুন আইন অনুযায়ী এখন সমস্ত কিছুই ভিডিয়োগ্রাফি করে রাখার কথা। কিন্তু পুলিশের ক্যামেরাধারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছয় সাড়ে ১২টার পরে। এই সময়ের মধ্যেই কলকাতার পুলিশ কমিশনার দলবল নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছন। কিন্তু তদন্তের বদলে তাঁদের দফায় দফায় অধ্যক্ষ এবং সুপারের ঘরে বৈঠক করতে দেখা যায়।”
কী কথা হয় সেই বৈঠকে? ওই হাসপাতালের এক চিকিৎসকের দাবি, “বৈঠকে পুলিশ, অধ্যক্ষ, সুপারের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ভবনের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত দু’জন ছিলেন। তাঁরা পুলিশ যাওয়ার আগে সেমিনার রুমে দাঁড়িয়ে একপ্রস্ত আলোচনা করেন। বৈঠকে পুলিশের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তা। ফোনে কথা বলা পুলিশকর্তারা বার বার বোঝার চেষ্টা করছিলেন, কী ভাবে মামলা হবে।” আর এক আন্দোলনকারী চিকিৎসকের দাবি, দফায় দফায় বৈঠক যখন চলছে, অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারেরা জড়ো হতে শুরু করেছিলেন। কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিক্ষোভ দেখাতে আসছে বলে পুলিশ সূত্রে খবর আসে। তাঁর অভিযোগ, “এই সময় অধ্যক্ষ তাঁর আস্থাভাজন কিছু চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ডেকে সামনে দাঁড়িয়ে পড়তে বলেন। হাসপাতালের ভিতরে রাজনীতি করা যাবে না— এই বার্তা দিয়ে আদতে নিজের লোক দিয়ে হাসপাতাল ঘিরিয়ে নেওয়া হয়।”
১২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ মৃত ঘোষণা করা হয় ওই চিকিৎসক-পড়ুয়াকে। ১টা ৪৭ মিনিটে দেওয়া হয় ‘ডেথ সার্টিফিকেট’। মৃতার মায়ের অভিযোগ, “পুরো সময়টাই আমাদের বসিয়ে রাখা হয়। পুলিশের হাতেপায়ে ধরেও মেয়ের মৃতদেহ দেখতে পাইনি। অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গেলেও বসিয়ে রেখে বলা হয়, ভিতরে জরুরি বৈঠক চলছে।” বিকেল ৫টা ১০ মিনিটে মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মর্গে। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সুরতহালের পরে ময়না তদন্ত শুরু হয় সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে। ৭টা ১০ মিনিটে ময়না তদন্ত শেষ হতেই পুলিশ মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে বার করে নিয়ে যাওয়ার তৎপরতা শুরু করে। রাত সাড়ে ৮টায় মৃতদেহ দেওয়া হয় পরিবারকে। এর পরে মৃতদেহ দাহ হয় উত্তর ২৪ পরগনার একটি শ্মশানে। সেখানকার কর্মীর দাবি, “লাইনে আগে দুটো মৃতদেহ ছিল। সেগুলি পেরিয়ে আগে এই মৃতদেহ দাহ করে ফেলতে বলা হয়। অত্যন্ত তাড়ায় ছিল পুলিশ।”
কেন? দিনভর কেস ডায়েরি হাতে ঘোরা পুলিশকর্মীর দাবি, “আসলে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল, ব্যাপার কোন দিকে যায়। মৃতদেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার তিন ঘণ্টা পরে এফআইআর হয়েছে। তত ক্ষণে রাত পৌনে ১২টা বেজে গিয়েছে।” অর্থাৎ মৃতদেহ উদ্ধারের পরে ১৪ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে। নিহতের পরিবার কখন অভিযোগ জমা দিয়েছিল? পরিবারের দাবি, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পরেই। তা হলে এফআইআর করতে এত দেরি কেন? উত্তর চাইছে দেশের শীর্ষ আদালতও।